গল্পে ঋতব্রত গুহ

বোনাস

“ মা আমি আমার খাবারটা টিফিন বক্স করে নিয়ে যাব !”
“ সে নিয়ে যাও ! কিন্তু এখানে খেয়ে নিলেই পারতে  , সকাল থেকে কিছু তো খাও নি ! ”
“ না মা । বাড়ি যেতে হবে । আমি না গেলে বাবাই এর খাওয়া হবে না !”
এ বাড়িতে পদ্মার রান্নার এত প্রশংসা হয় । কিন্তু পদ্মা কোন রান্নাই ছেলের জন্য নিয়ে যেতে পারে না । বাড়ির মালকিন খুব রাশভারি । ছোটখাটো ভুল ত্রুটি তেও ভীষণ বকাঝকা করেন । দিন দশেকের জন্য তিনি বাইরে গিয়েছেন । বৌ মা আবার মাটির মানুষ । তার কাছে সাধ করে কিছু চাওয়া যায় । কখনো কিছুতে না বলেন না ।
“ বাড়ি নিয়ে গেলে , তুমি তো নিজে খাবে না । তুমি ছেলের জন্য নিতে চাইছ । তাই তো ! ”
পদ্মা একটু অস্বস্তি বোধ করল ।
“ হ্যাঁ মা  !”
“ তুমি এখানে খেয়ে নাও  , আর ছেলের টা নিয়ে যাও । তবেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ।”
পদ্মা হাসল । “ তুমি না মা অনেক ভালো । সবার মত না ! “
পদ্মার মনটা আজ আনন্দে ভরে রয়েছে । ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন টা আজ খুব সুন্দর হয়েছে  । বাবাই ফ্রায়েড রাইস টা খুব ভালোবাসে । ঘরে আলো জ্বলছে । বাবাই ফিরে এসেছে নিশ্চয়। পদ্মা ভেতরে গিয়ে দেখে বাবাই চুপ করে বসে রয়েছে ।
“ কি হয়েছে , শরীর খারাপ নাকি ! ”
বাবাই মাথা নাড়ল ।
“ চাকরি টা হয় নি তো ! ”
“ না ! শেষ রাউন্ডে এসে ছিটকে গেলাম !”
পদ্মা বাবাই এর  মাথায় হাত রাখল “ লেগে থাক । ঠিক হয়ে যাবে ! “
বাবাই ছোটবেলার থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো । বাবা যখন মারা যায় তখন বাবাই এর বয়স সবে চার । দারিদ্রের সাথে তখন পদ্মার নিত্য সংঘাত । লড়াইয়ের সেই শুরু । রান্নাটা খুব ভালো করত পদ্মা । সেই গুণ বেচেই সংসার যুদ্ধে বেঁচে থাকা , এখনও সেই কাজ করেই সংসার চলে পদ্মার  । কত কঠিন সময় এসেছে , পদ্মা হার মানেনি । মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল বাবাই । বাবাই চেয়েছিল কাজ করে মা এর পাশে দাঁড়াতে । পদ্মার সায় ছিল না । পদ্মা খুব চাইত বাবাই অনেক বড় হোক । পদ্মা যেই সমস্ত বাড়িতে কাজ করত দেখত ওদের ছেলে মেয়েরা কত পড়াশোনা করে , কত ভালো ভালো চাকরি করে । পদ্মা চাইত বাবাই ও ওদের মত হোক । একটা ছোট ভাড়ার ঘরে থেকে এমন স্বপ্ন ছোয়া যে খুব সহজ নয় তা পদ্মা বিলক্ষণ জানত । কিন্তু চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না । বাবাই এ বছর পলিটেকনিক পাশ করেছে । এখন চাকরির চেষ্টা করছে ।
“ এখন খেয়ে নে ! তোর জন্য খাবার এনেছি ! ” বাবাই এর চোখে জল । বাবাই জানে তার মা নিজের জীবনের সব সখ আহ্লাদ তুচ্ছ করেছে বাবাই এর সুখের জন্য ।
“ তুমি তোমার খাবার টাই এনেছ না মা ! ” বাবাই এর মাথায় হাত রাখল পদ্মা ।
“ জানিস বৌ মা  খুব ভালো ! আমি খেয়ে এসেছি । তোর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে ! ”
“ খুব ক্লান্ত লাগছে ! একটু খাইয়ে দেবে মা ! “
পদ্মার শরীরটা কদিন যাবৎ সুবিধের যাচ্ছে না । মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে । ডাক্তার দেখিয়েছে পদ্মা , ডাক্তার বাবু অনেক টেস্ট দিয়েছেন । বাবাইকে কিছুই জানতে দেয় নি পদ্মা । বাবাই এখন চাকরির চেষ্টা করছে । এ সময় বাবাই এ সব কথা জানলে সব মাথায় তুলে মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে । পদ্মার ওজনটাও অনেকটা কমে গিয়েছে । বাবাইএর নজর এড়ায়নি ।
“ মা এবার তুমি একটু কাজ কম কর তো ! তোমার বয়স হচ্ছে । আমি খুব তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়ে যাব । তোমাকে আর কাজ করে সংসার চালাতে হবে না  ! ” টেস্ট গুলো করানোর খুব দরকার । কিন্তু টাকা কোথায় ! যা রোজগার তা দিয়ে এই বাজারে পেরে ওঠা যায় না । বাড়ি ভাড়া , প্রতিদিনের খরচ আর দুবেলা খেয়ে কিছুই প্রায় অবশিষ্ট থাকে না । দুমাস বাদে পূজা । যদি বোনাস টা এ মাসে পাওয়া যেত খুব ভালো হত । স্যালারি টা আবার মালকিনের ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ চাইতে গেলে মালকিনের কাছে চাইতে হবে । আজকে একদম কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না পদ্মার । শরীর টা একদম ভালো লাগছে না । কিন্তু না গিয়ে উপায় নেই। মালকিন আসবে বলে কথা । আজ বাদ দিলে চলবে না । পদ্মার টাকাটা খুব দরকার । ডাক্তার বাবু বলেছেন টেস্ট গুলো হলে তিনি ট্রিটমেন্ট শুরু করতে পারবেন । পদ্মা ঠিক করেছে এবার বোনাসের টাকাটা দিয়ে ট্রিটমেন্ট করাবে । নূতন জামাকাপড় এবছর আর কিনবে না । আজ সুযোগ বুঝে বোনাসের টাকাটা চেয়ে নেওয়া যাবে ।
“ মা তুমি ঠিক আছ তো ! ”
“ একটু মাথাটা ধরেছে , এই সময় টায় হয় এমন ! তোকে ভাবতে হবে না । আর দেরি করিস না , বেরিয়ে পড় । ”
বাবাই মা কে প্রণাম করল । আজকের ইন্টারভিউ টায় একটা ভালো সুযোগ রয়েছে ।
“ আমি আসছি মা ! তুমি সাবধানে থেকো ! “
আজকে একটু দেরি হল পোঁছতে !
“ কি আজকে দেরি হল যে ! ”
“ আজকে শরীরটা একদম ভালো লাগছে না দিদি ! ”
“ এমন দেরি করলে তো আমাদের হয় না । সবাই চাকরি বাকরি করে , এত অসুস্থ হলে আমাকে বলে দাও । আমি অন্য লোক দেখি ! ”
“ না না দিদি ! আর হবে না ! একটা কথা ছিল দিদি ! ”
“ বল !  ”
“ দিদি বলছিলাম পূজোর বোনাস টা কি আগে পাওয়া যাবে ! মানে একটু ট্রিটমেন্টের দরকার ছিল ! ”
“ এমাসে একদম হবে না গো ! খুব ক্রাইসিস চলছে । পূজো তো আগে আসুক । তুমি বোনাস নিয়ে ছেড়ে দিলে তখন কি করব ! এখন হবে না ! “
মাঝে মাঝে পদ্মার মনে হয় কাজটা ছেড়ে দিতে । মালকিন কারণে অকারণে এত অপমান করেন ! কিন্তু এত মাইনে এই পাড়ায় অন্য কেউ দেবে না । যেদিন বাবাই চাকরি পাবে পদ্মা মালকিন কে ঠিক দু কথা শুনিয়ে দেবে । আজ বৌ মা ও বাড়িতে নেই । থাকলে হয়ত নিশ্চয় বুঝতে পারত । তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করা শুরু করল পদ্মা । মাথাটা ঘুরছে খুব । আলো ক্রমশ কমে আসছে । মনে হচ্ছে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে । বাবাইয়ের চাকরি টা কি হল !
আগের দুটো রাউন্ড ভালো ভাবেই পেরিয়ে এসেছে বাবাই । এবার লাস্ট রাউন্ড । এখনি ডাকবে বাবাইকে । মায়ের ফোনটা সুইচ অফ বলছে । প্রতিদিন মা বাড়িতে গিয়ে একবার ফোন করে । আজ এখনও করেনি  । হয়ত চার্জ দেয়নি । স্বপ্নপূরণের আর মাত্র এক ধাপ বাকি । এবারটায় মনে হচ্ছে হয়ে যাবে । বাবাইয়ের মাথায় ঘুরছে অনেক স্বপ্ন । মা এর যুদ্ধের কথা ।বর্ষার সময় ঘর জলে ভেসে যেত , একটা গ্যারেজের এক কোণে কেটে যেত গোটা বর্ষাকাল । সব অতীত ফিরে আসছে চোখের সামনে ।
“ অনির্বাণ দাস ! “
“ দাদা ! এই যে আপনার দুটো প্যাকেট ! “
পদ্মা বিরিয়ানি খেতে খুব ভালোবাসে  । একবার এই দোকান থেকে মা কে বিরিয়ানি খাইয়েছিল বাবাই । পদ্মা খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিল । মাথাটা ফাকা হয়ে রয়েছে বাবাইয়ের ! কি যে অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে । প্রথমেই মাইনে মাসে পঁচিশ হাজার । ছ মাস বাদে সেটা বেড়ে তিরিশ হাজারের মত হবে । মা কে একটা বাড়ি বানিয়ে দেবে বাবাই । কাল মাকে শপিং মলে নিয়ে যাবে , মা কোনদিন যায় নি শপিং মলে। মাঝে মাঝেই বাবাইকে অবাক চোখে প্রশ্ন করত পদ্মা “ ওখানে বিনে পয়সায় যাওয়া যায় ! “
বাড়ির সামনে একটা ছোট ভিড় ! বাবাইয়ের বুকটা কেঁপে উঠল । ভিড় ঠেলে বাবাই সামনে এগিয়ে গেল !
“ বাবাই তুই এসেছিস ! তোকে সবাই পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে ! ” হাউহাউ করে কাঁদছে পাশের বাড়ির কাকিমা ।
বাবাই ঘরে ঢুকল । বিছানার ওপর শুয়ে আছে পদ্মা ।
“ মা আমার চাকরি হয়ে গিয়েছে , পঁচিশ হাজার মাইনে ! ”
পদ্মা কোন উত্তর দিল না ! বাবাই মা এর কপালে হাত দিল । শীতল দেহ , প্রাণহীন দেহ ।
“ আজকে কাজে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় পদ্মা ! স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল । সাথে সাথেই হাসপাতালে নিয়ে যাই আমরা । ততক্ষণে উনি মারা গিয়েছেন । “
ভিড়ের মধ্যেই একজন ঘটনাটি সংক্ষেপে বলল । নিথর হয়ে বসে রইল বাবাই ।
মা এর দাহকার্য সম্পূর্ণ হচ্ছে । নীচে বসে রয়েছে বাবাই । রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে । কাল এসময়ই বাবাইয়ের মাথায় হাত রেখে পদ্মা বলেছিল “ দেখিস , কাল চাকরিটা ঠিক পেয়ে যাবি ! ” বাবাইয়ের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে “ মা আমি চাকরিটা পেয়েছি ! ” কিন্তু মা আর শুনবে না । দুজনের একসাথে সুখে থাকা আর হল না এ জীবনে । ভগবানে গভীর বিশ্বাস ছিল বাবাইয়ের , আজ থেকে আর বিশ্বাস করবে না । পৃথিবীর ভগবান যে ওদিকে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।