• Uncategorized
  • 0

গল্পে আত্রেয়ী রায়

আদ্যন্ত রোমান্টিক বাঙালি। প্রথম প্রেম সাহিত্য। লেখালেখির শুরু কলেজ জীবনে। সংসারের কাজ আর পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুবান্ধব আর মেয়ের উৎসাহে নতুন করে লেখালেখির শুরু। ভালোলাগার ক্ষেত্র বিস্তীর্ণ নাচ, গান, নাটক, সিনেমা আর ভ্রমণেও।

রাজেশ্বরীর পুত্র

অধিকাংশ বঙ্গনারীর ন্যায় রায়বাবুর গর্ভধারিণীও বাল্যকাল হইতে তাহাকে শিখাইয়াছেন আপন ব্যবহৃত অন্তর্বাস গৃহের যত্রতত্র ফেলিয়া রাখিতে, বাহির হইতে ঘরে ফিরিয়া ধূলিআচ্ছাদিত পাদুকাদ্বয় নির্দিষ্ট স্থানে না রাখিতে, পানাহারের সময় চা, কফি, তরকারি ও মাংসের ঝোলের ফোঁটা জামায় না ফেলিয়া খাইতে নেই,শয্যার আচ্ছাদন না বদলাইয়া, না কাচিয়া, না ঝাড়িয়া দীর্ঘকাল ব্যবহার করিতে হয়। আহারের পর সাবান দিয়া হাত ধুইতে শিখাইয়াছেন, ভিজা হাতখানি যে বেসিনের পার্শ্বে ঝুলন্ত পর্দায় মুছিতে নাই তাহা শিখান নাই। স্নানের পরে ব্যবহৃত সিক্ত সম্মার্জনী নির্দ্বিধায় শয্যায় ফেলিয়া রাখিতে হয়, চেয়ারের হাতলে, সোফার কোনায় এবং আরো নানান সম্ভব অসম্ভব স্থান হইতে কুন্ডলীকৃত অবস্থায় তাহা উদ্ধার করিতে হয় পরবর্তী ব্যবহারের পূর্বে, এমত শিক্ষা রায়বাবু বাল্যকাল হইতেই লাভ করিয়াছেন। গর্ভধারিণী তাহাকে আরো শিখাইয়াছেন যে, এসব তুচ্ছ কাজ তাহার হইয়া জীবনভর করিবার নিমিত্ত এক সরলা বালিকা বঙ্গদেশের কোন এক গোকুলে নিশ্চিত বাড়িতেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। যথাসময়ে সেই বালিকা তরুণী হইবে, এবং গৃহে আসিয়াই রায়বাবুর সেবায় নিজেকে সমর্পন করিবে। রায়বাবুর প্রাত্যহিক জীবনের সুখসাধনই হইবে তাহার কর্ম।
কালক্রমে রায়বাবু বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেন। নামী বহুজাতিক কোম্পানিতে বড় পদে চাকুরি জোগাড় করিলেন এবং স্বীয় পরোপকারী স্বভাব ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের দ্বারা সকলের মন জয় করিয়া লইলেন। বিবাহের বয়স হইলে মাতার অনুমত্যানুসারে একটি সুলক্ষণযুক্তা কন্যা বিবাহ করিয়া ঘরে আনিলেন। বিবাহের পর বেশ কাটিতে লাগিল। কন্যাটি সুশীলা। নব্যবিবাহিত স্বামীর প্রতি অনুরাগ বশতই হউক বা শ্বশুরবাড়িতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিবার নিমিত্তেই হউক স্বামীর আরাম বিরামের কোনরূপ বিঘ্ন সে উপস্থিত করিল না। রায়বাবু ভাবিলেন, জীবন এমতই সুখের। অনভিজ্ঞতাহেতু রাজেশ্বরী (পিতামহ কর্তৃক প্রদত্ত নাম, তাই কিঞ্চিত পুরাতন) নাম্নী বধূটি গৃহকর্মে অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্তি করিয়া বসিত, যাহা শ্বশ্রুমাতার দৃষ্টিতে কদাপি ক্ষমার্হ হইত না। পিত্রালয় হইতে সে কোনরূপ গৃহকর্ম শিক্ষা করিয়া আসে নাই, ইহা তিনি বারংবার স্বামীপুত্রের নিকট প্রমাণ করিয়া ছাড়িতেন। বধূটির সামান্যতম ত্রুটি তাহার দৃষ্টিতে রীতিমত ইচ্ছাকৃত স্খলন বলিয়া  প্রতিভাত হইত।
বধূটি কোনপ্রকার পেশা গ্রহণ না করিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্তা। পিতা-মাতা-পিতামহের ছত্রছায়ায়,  আদরে ও সুশিক্ষায় পালিত হওয়ায় অতীব মৃদুভাষী ও প্রতিবাদ পরান্মুখ। স্বামীর নিকট তাহার মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করিতে তাহার রুচিতে বাধিত। রাত্রিকালীন একান্ত নিভৃতিটুকু সে ভরিয়া তুলিতে চাহিত প্রেমে, অভিযোগে নহে। সদাব্যস্ত রায়বাবুও সাংসারিক মহিলাকেন্দ্রিক সমস্যাগুলিকে তুচ্ছ জ্ঞান করিতেন। স্ত্রীকে সকলপ্রকার প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাইয়া স্বামী হিসেবে আপন কর্তব্য সমাধা করিয়াছেন ভাবিয়া মনে মনে পরম পরিতোষ লাভ করিতেন।
দিন কাটিল। রাজেশ্বরীও পুত্রসন্তানের মা হইল। কালক্রমে তাহার সাংসারিক বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটিল। তাহার স্বভাবসুলভ নম্রতা খানিক হ্রাস পাইয়াছে। এখন তার মস্তিষ্ক ও জিহ্বা উভয়ই সমান তীক্ষ্ণ। সাংসারিক রাজনীতি তাহার নখদর্পণে। শ্বশ্রুমাতাকে সে প্রায়ই বাক্যবাণে বিদ্ধ করে পুত্রকে গৃহস্থালির কাজে উপযুক্ত শিক্ষা না দিবার জন্য। আপন পুত্র ঋজুকে সে পুস্তক, বস্ত্রাদি, জুতা, খেলিবার সামগ্রী প্রভৃতি স্বস্থানে রাখিবার শিক্ষা দেয়। আহারের পর ব্যবহৃত পাত্র ধুইয়া রাখিতে, আপন শয্যা স্বহস্তে প্রস্তুত করিতে, বস্ত্রাদি ধুইতে, পূজার কার্যে পিতামহীকে সাহায্য করিতেও শিখায়। এমত নারীসুলভ শিক্ষা পুরুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের অনুপযোগী, পিতামহীর এমনটাই মত। মায়ের আদর্শে ও ইংরেজি মাধ্যমে বিদ্যাশিক্ষা করিয়া ঋজু বিজ্ঞানমনস্ক ও সর্বপ্রকার কুসংস্কারবর্জিত ষোড়শবর্ষীয় এক কিশোরে পরিণত হইয়াছে। সর্ববিষয় যুক্তির দ্বারা বিচার করিয়া সে কোন মত গ্রহণ করে। মায়ের নিকট হইতে সে শিখিয়াছে যে শিক্ষায় নারীপুরুষ প্রভেদ নাই। সকল সুশিক্ষাই উভয়ের জন্য। যাহা কিছু মন্দ ও নিন্দার্হ তাহা উভয়ের জন্যই মন্দ ও নিন্দার্হ। বলাবাহুল্য, পিতামহীর তুলনায় মায়ের শিক্ষাই তাহার নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
আজকাল বয়সোচিত কারণে প্রতিমাসেই রাজেশ্বরী ঋতুকালীন বেদনায় শয্যা নেয়। এমতাবস্থায় একদিন রায়বাবু অফিস হইতে বাড়ি ফিরিয়া দেখেন তাহার পুত্র ঋজু শয্যায় শায়িত মায়ের উদরে গরম জলের থলি দ্বারা সেঁক দিতেছে। বড় অবাক হইলেন তিনি। কখনো ভাবেন নাই, এসময়ে নারীদের কোনরূপ সেবাযত্নের আবশ্যকতা হয়। তাহার মায়েরও তো এবম্বিধ শারীরিক পীড়া কত হইয়াছে, অথচ তিনি নির্দ্বিধায় পীড়িতা মায়ের সেবা-যত্ন গ্রহণ করিয়াছেন। বিগত বৎসরগুলিতে স্ত্রীকেও দেখিয়াছেন মাসের এই বিশেষ দিনগুলিতে কষ্ট পাইতে, অথচ ইহাকে নারীর অবধারিত ললাটলিপি মনে করিয়া দৃকপাতমাত্র করেন নাই। পুত্রকে মায়ের সেবা করিতে দেখিয়া আজ বুঝি তাহার কিছু চিত্তবৈকল্য ঘটিল। ধীরে ধীরে পুত্রের মস্তকে হস্তসঞ্চালন পূর্বক বেদনার্দ্র কন্ঠে কহিলেন,
“আহা রে! আমিও যদি এমন হতাম!”
শয্যা হইতে উঠিয়া কক্ষান্তরে যাইতে যাইতে পুত্র কহিল, “হাতমুখ ধুয়ে নাও বাবা। আমি খাবার বাড়ছি। আলোটা নিভিয়ে দাও, মা একটু রেস্ট নিক।”
আলো নিভাইয়া রায়বাবু অধোবদনে পুত্রের পশ্চাতে পশ্চাতে কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। শয্যায় রাজেশ্বরী প্রশান্ত হৃদয়ে চক্ষু মুদিল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।