গল্পে অয়ন ঘোষ

সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি

একটা প্রান্তিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে, আমরা অভ্যাস করে নিয়েছি পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া। কথায় কথায় বলতে শিখেছি, ” আরে বস, কুল”। আজকাল আর কিছু স্পর্শ করে না আমাদের, সব কিছুই মনে নিতে না পারলেও মেনে নিতে শিখে গেছি। সুক্ষ অনুভূতি গুলো কেমন যেন মোটা দাগের হয়ে গেছে। গায়ের চামড়া মোটা হওয়ার থেকেও বেশি ক্ষতি হয়েছে বৌদ্ধিক ও হৃদয়গ্রাহী সংবেদনশীলতা গুলো মোটা হয়ে যাওয়াতে। আর এখানেই প্রতিদিন মার খাচ্ছে কালো পিঁপড়ের দল। পড়ে গেছে অস্তিত্বের সংকটে। আমি গাঁয়ের ছেলে, আগে দেখেছি, পাড়াতে কেউ মারা গেলে, পাড়ার ছেলেরা সবাই মিলেমিশে সৎকার করতে তো যেতোই, আর মা কাকিমারা সেই বাড়ির মানুষজনের সাথে সাথে ওই দুর্ভাগ্যের সমব্যথী হতে আসা আত্মীয় কুটুম্বদেরও খেয়াল রাখতো।  তারা মনে করত, এটা না করলে গ্রামের মান থাকবে না।  এখনও কিছু লোক জোটে ভব নদী পার করিয়ে দেবার আয়োজনে,তবে তা নেহাতই লাল জলের আগ্রহে। একই ভাবে কোনো শুভ অনুষ্ঠানেও সকলে মিলে কাজ উৎরে দেওয়ার মানসিকতা ছিল। পাড়ায় কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি থাকলে, অনুষ্ঠানের আগের দিন বিকেল বেলায় পাড়ার বৌ ঝি রা হাতে একটা করে বটি নিয়ে হাজির হতো সেই বাড়িতে, পরের দিনের আনাজ কেটে দেবার জন্য। একদল মানুষ ছিলেন, যাদের কাজই ছিল, যে কোনো অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশন করা, তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার, গুরুত্বপূর্ণ পদ, মাংস, মাছ, মিষ্টি এইসব পরিবেশনের জন্য বিশেষ ভাবে দক্ষ ছিলেন, মানে রীতিমতো স্পেশালিস্ট। জমাট দইকে কিভাবে চামচ ভাসিয়ে কাটতে হয়, যাতে জল কেটে না যায়, তা ছিল বড়দের কাছ থেকে শিখে নেওয়ার বিষয়। পাড়ার বেশ কয়েকজন কাকু বা জেঠুকে আমি ছোটবেলায় প্রায় সব বাড়ির অনুষ্ঠানে ভাড়ারি হতে দেখেছি। ওই বিষয়ে ওনাদের দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত।গৃহ কর্তাও ওনাদের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত থাকতেন। এই সব কিছুকে নিজের করে ভাবা, “আমি” ছড়িয়ে “আমাদের” বোধটাই, ছোটবেলায় শেখা সবচেয়ে বড় জীবনদর্শন ছিল আমাদের কাছে। কোমরে গামছা বাঁধা ওই মানুষগুলো যেনো, আস্তে আস্তে কোথায় হারিয়ে গেলেন, আনুষ্ঠানিকতার গুঁতোয়। আজ সব যেন কেমন মাপা পেশাদারিত্বের চকচকে রঙিন কাগজে মোড়া। সেখানে আলো আছে, বৈভব আছে, দেখনদারির বাঁকা চাওনি আছে, আর আসল জিনিসটাই নেই – প্রাণ। এই আসরে এখন মাপা হাসি, চাপা কান্নার দরে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতার সংখ্যা কম নয়, বরং কিছুটা বেশিই। আগে মধ্যবিত্ত মানুষ বৈভব নিয়ে কুঁকড়ে থাকতো, এখন উদযাপন করে বেহায়ার মতো।
তা করুক, কিছু যায় আসে না। এগিয়ে যাবার নামই নাকি জীবন। তার উদার আকাশে নদী রঙের ঢেউ। পরতে পরতে বৈচিত্রের সম্ভার, বিচিত্র পসরা নিয়ে গবলিনের দল, সদা বলছে ” কিনবে এসো, কিনবে এসো”। লিজির হাজার বারণ স্বত্বেও, আমরা ছুটে যাচ্ছি বড় থেকে আরও বড় হয়ে ওঠা বাজারের পানে, কারণ বিজ্ঞাপন বলছে, “মেক ইট লার্জ”। আমাদের এই ছুটে চলার দুপাশে, রয়ে যাচ্ছে অজস্র “মিনেস্ট ফ্লওয়ার”, যার খবর দিতে পারছে না আমাদের হাওয়া অফিস। দুপাশের বাতাস ভারী হচ্ছে ক্রমশঃ মৃত সম্পর্কের গন্ধে। বিনা গ্যাসওয়ালা সুগন্ধী ঢেকে দিচ্ছে আমাদের সব অপরাধ বোধ। বিপননের বাজারে আমরা বুঝে গেছি যে যত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলতে পারবো আমাদের জাফরান রঙের পিছুটান, ততই আমাদের সাফল্যের মুকুটে লাগবে আলেয়ার ঝলক। তাই এখন আমরা আলোর উৎসবে নয়, আলেয়ার বাসরে শরীর সাজাই, মন ভোলাই। আমাদের গাঁ ঘরের রূপকথার পৃথিবীটা কেমন যেন, রাক্ষুসী রানীর অভিশাপে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে, চৈত্রের সর্বগ্রাসী দুপুর গুলোর মতো। দিনে মানে কাছেপিঠে কেউ কোথাও নেই। মাথার ওপর একাদশীর আকাশ, দু পা মেলে দিয়ে বসে আছে জীবনভর সর্বনাশী কন্যা, তার ধূ ধূ সিঁথির ওপর বসে একটানা ডেকে যাচ্ছে একটা কাক, মুছে দিয়ে জীবনের সব রঙ।
এরপরের চাঁদ সূর্য উঠছে হিসেবমত। বিশুদার চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে মারতে আতলামি টাকে নিয়ে গেছি প্রায় শিল্পের পর্যায়ে। দেওয়ালে দেওয়ালে বিপ্লবের সূচনা। ঝড় উঠেছে সামাজিক মাধ্যম থেকে বুদ্ধিজীবীদের মগজে। নোটিফিকেশন এ বোঝাই মুঠোফোন। যে কোনো মুহুর্তে জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস হয়ে, শ্রেণী সংগ্রামের জয়টীকা এঁকে দেবে আমাদের কপালে। সেই অবসরে কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে প্রান্তিক কোনো মা, তার সন্তানের মুখের ওপর টেনে দেবে ফিনফিনে কুয়াশার চাদর। বুকের ওমে তাকে শোনাবে সরল সাদাসিধে জীবনের আখ্যান, যেখানে আদি দিগন্ত কাশবন পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছে দুই ভাই বোন, রেলগাড়ির কু ঝিক ঝিক আওয়াজে  ঢাকা পড়েছে তাদের মনের যাবতীয় মালিন্য, দু চোখে স্বপ্নের কাজল পড়িয়ে দিয়েছে এই  জীবনের আশ্চর্য বিস্ময়। এখানে নেই হারিয়ে ফেলার বা হেরে যাবার ভয়। প্রাণের অপার সম্ভাবনার কাছে জমা রইল নিভৃত হৃদয়ের নৈবেদ্য। এখানে সোনার বা হীরের খনির জৌলুস ঢাকা পড়ে যায় মনের ঐশ্বর্যের কাছে। যে মনের আকাশের চাঁদটা ছোটবেলায় আমি মামারবাড়ি গেলে, সেও যেতো আমার সঙ্গে। বড় ঘরের দাওয়ার ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকতো আমার আর ভাই এর মাঝে। সেই ছিল আমাদের আপনাদের সোনার কাঠি রূপোর কাঠির জীবন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।