গল্পে অমিতাভ রায়

ঈর্ষা

মেল চেক করতে গিয়ে চমকে গেল আকাশ। চাকরিটা কি পেয়ে গেল শেষপর্যন্ত! বুক ঢিপঢিপ করছে ওর। শান্তি! ওকে জয়েন করতে বলেছে! চোখ বুজে কিছুক্ষণ বসে থাকলো আকাশ। বাবা- মাকে জানাতেই বাড়িতে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গেলো।
বাবা তো প্রায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়েই শান্তিকে বলছে,” তোর আকাশদাদা তো আমেরিকায় বড় চাকরি পেয়ে গেল রে!” শান্তি ওদের বাড়ি রান্না করে। যদিও বাবার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে মেঘমালার বাবা-মাকে শোনানো, সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। এতদিন ছেলে কেবল হেরেই এসেছে-আসল সময়েই টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল! বাবা- মার আনন্দ আর দেখে কে?
বাবা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাকে বলছে,” মাংস আনতে চললুম। একেবারে রেওয়াজি খাসির মাংস আনবো। ” পাশের বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। না হওয়ারই কথা। আকাশ ছাদে উঠে যায়৷ আজ বোধহয় বিশ্বকর্মা পুজো। আকাশভর্তি ঘুড়ি৷ দুপুরের রোদ মরে গিয়েছে। সুন্দর একটা হাওয়া দিচ্ছে। পাশের ছাদে মেঘমালার মা। ছাদে মেলা কাপড়- চোপড় নিতে এসেছে। এদিকে একবারও না তাকিয়ে দ্রুত জামাকাপড় নিয়ে নেমে গেল। আকাশের হাসি পেয়ে গেল। স্কুল- কলেজ থেকে শুরু করে সব পরীক্ষায় মেঘমালা ওকে হারিয়েছে। ওর বাবা- মার তা নিয়ে গর্বের শেষ নেই। ঠারে ঠারে অনেক কথাই শুনিয়েছে ওর বাবা- মাকে। পাড়ার মুদির দোকানের মালিক নেতাই পর্যন্ত জানে, মেঘমালা ওর থেকে ভাল মেয়ে। আর, এখন আকাশ যে এই নামী সংস্থায় চাকরি পেয়ে গেছে তাতে পাশের বাড়ির রাতের ঘুম যে উড়ে যাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত ও। একটা ঘুড়ি কেটে এদিকেই আসছে। ছেলেগুলো হইহই করতে করতে নীচে রাস্তায় দৌড়চ্ছে। একটু লাফিয়ে হাত বাড়াতেই সুতোটা পেয়ে গেল আকাশ। ঘুড়িটাকে হাতে নিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে হইহল্লা থেমে গেছে। ছেলেগুলো হতাশ -নিশ্চুপ। ঘুড়িটাকে নীচের দিকে ভাসিয়ে দেয় আকাশ। ঘুড়িটা ঘুরতে ঘুরতে নীচে পড়ছে। বিস্মিত ছেলেগুলো একমুহূর্ত নীরব থেকে তারপরেই চেঁচিয়ে উঠে ঘুড়ির দিকে দৌড়য়। আকাশের বেশ মজা লাগে। শেষ বিকেলের আকাশের দিকে তাকাতে বেশ ভাল লাগে ওর। কি সুন্দর রাঙিয়ে উঠেছে আকাশটা। পাশের ছাদে মেঘমালা উঠেছে না? আড়চোখে আকাশ দেখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছু বলবে মনে হচ্ছে। আকাশ ইচ্ছে করেই অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে দেখে, মেঘমালা আর ছাদে নেই। নীচে নেমে গেছে। সন্ধ্যা নামছে। আকাশের রঙ মুছে যাচ্ছে অন্ধকারে। আকাশে ঘুড়ির সংখ্যা কমে গিয়েছে। একটা ভিজে ভিজে বাতাস বইছে। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। নীচে নেমে এল আকাশ।
” দাদুভাই, তুই বিদেশে চলে যাবি?” আকাশ মাথা নাড়ে।
” যা, তোকেও তো উন্নতি করতে হবে। তাই না? আমাদের বুড়োদের দিন চলে গিয়েছে। ”
আকাশ জানে, ও চলে গেলে দাদু একেবারে একা হয়ে যাবে। মাংসের গন্ধে ভরে গেছে চারদিক। বাবা আনন্দ হলে হেমন্তর গান শোনে। আজও শুনছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। বন্ধুদের খবরটা জানাতে হবে। আকাশ নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় আধশোয়া হয়ে এক এক করে ফোন করতে শুরু করে। বাইরে থেকে একটা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে। বাবা- মাকে খুশী দেখে আকাশের আজ খুব ভাল লাগছে। মেঘমালার বাবা আগেই গাড়ি কিনেছিল। যেদিন গাড়ি নিয়ে এই গলিতে ঢুকলো মেঘমালার বাবা- তখন আকাশ দেখেছিল বাবা- মার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। আকাশ একদিন দেখে বাবা আর মার গাড়ি কেনা নিয়ে আলোচনা জমে উঠেছে। তবে বাবা যে গাড়ি কিনবে তার দাম অনেক বেশী। বাবা বলেই দিল,” ঐসব পাতি গাড়ি কিনে লাভ নেই। ”
সেটাই হল। প্রচুর লোন করে বাবা গাড়ি কিনল। সেই লোন এখনও শোধ হচ্ছে। তখন আবার মেঘমালার বাবা- মার মুখে নেমে এসেছিল অন্ধকার। আকাশের ফোন শেষ হল এতক্ষণে। বৃষ্টি বোধহয় বেড়ে গিয়েছে।
হেমন্তের গলা ভেসে আসছে,” ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস। ”
কি একটা ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। কি ফুল কে জানে? দাদু বলতে পারে- দাদু সব জানে। আর মাত্র কিছুদিন। তারপরেই স্বপ্নপূরণ। বড্ড ঘুম পাচ্ছে আজ। বেশী আনন্দ হলে কি ক্লান্ত লাগে? কে জানে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে আকাশ খেয়াল করেনি। মা ডাকতে ধড়ফড় করে উঠে দেখল- অনেক বেজে গেছে৷ খিদেও পাচ্ছে। মার কোলে মাথা গুঁজে দিল আকাশ।
মা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,” এতদিন পরে তুই আমাদের স্বপ্ন পূরণ করলি। তবে তুই চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে, অভ্যেসও হয়ে যাবে। তোর বাবা রিটায়ার করলে ওখানেই গিয়ে থাকবো।”
মহালয়ার ভোরবেলায় দাদুর ঘরে গিয়ে কেবল টিভির রেডিওতে দাদুকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অনুষ্ঠান শোনালো আকাশ। দাদু নিজে এসব পারে না। দাদুর পাশে শুয়ে শুয়ে ও নিজেও শুনলো। পুরনো দিনের সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর৷ দাদু আর ঠাম্মার মাঝখানে শুয়ে কেমন মহালয়া শুনতো, আর দাদুকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে তুলতো। আকাশের যেমন ঠাম্মা আর নেই- মেঘমালার আবার উল্টোটা। ওর দাদু নেই।
” বুঝলি দাদুভাই, তুই পুজোটা কাটিয়ে গেলে ভাল হতো। ”
আকাশ জানে ওর উপায় নেই৷ তাই ও কোনো উত্তর দেয়না। আজকাল আকাশের মনে হচ্ছে মেঘমালা ওকে কিছু বলতে চাইছে। সেদিন ছাদে ওকে দেখার পরে আরো কয়েকবার রাস্তায় দেখা হয়েছে। আকাশ অভ্যাসবশত মাথা নীচু করে চলে এসেছে। কিন্তু,ওর মনে হয়েছে ওর দিকে তাকিয়ে মেঘমালা যেন কিছু বলতে চাইছে৷ আবার এটাও হতে পারে এসবই আকাশের কল্পনা মাত্র। সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ ভাবছিল, এই পাড়া, বন্ধু- বান্ধব সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। একটু কষ্ট লাগছে বটে, তবে স্বপ্ন দেখতে গেলে সব কিছুই তো ছাড়তে হয়। বাইরে থেকে কে যেন ওকে ডাকছে না? তাইতো মনে হচ্ছে। জানলা দিয়ে আকাশ দেখে মেঘমালা ওকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি নীচে নেমে যায় আকাশ।
” আকাশ, বাবাই কিরকম করছে! কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।” আকাশ জামাকাপড় বদলে বেরিয়ে আসে। বাবা- মা সব শুনে চিন্তা প্রকাশ করলেও ওদের মুখ গম্ভীর। আকাশের যাওয়াটা ওদের খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। কিছু বলতেও পারছে না। আকাশ গিয়ে বুঝতে পারে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে বিপদ হতে পারে৷ ও বুঝতে পারলো মেঘমালাদের আত্মীয়স্বজন আশেপাশে কেউ থাকেনা। ওরা এখন একেবারেই অসহায়। ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মেঘমালার বাবাকে নিয়ে ও হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মেঘমালা আর ওর মা টাকাপয়সা নিয়ে উঠে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সে।
ডাক্তার খুব চিন্তিত মুখে চিকিৎসা শুরু করে দিল। সারারাত ধরে যমে মানুষে টানাটানি চলল। শেষরাতে বোঝা গেল এ যাত্রায় বেঁচে গেল মেঘমালার বাবা। তবে বাইপাস সার্জারি করতে হবে শিগগিরই৷ মেঘমালা আর ওর মাকে বাড়িতে পৌঁছে দিল আকাশ। মেঘমালা ওর সঙ্গে গেট পর্যন্ত গেল। আর একদিন মাত্র আকাশের থাকার কথা এখানে। গেট থেকে বেরোবার মুখে মেঘমালা ওর হাতটা চেপে ধরে। আকাশ দেখে মেঘমালার মুখে যেন শ্রাবণের মেঘ। বোঝাই যাচ্ছে, প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। আকাশ মেঘমালার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
” তুই এখনো বুঝতে পারলি না? ” আকাশের বুকের ভিতরে কিছু একটা গলে যাচ্ছে যেন।
” তোকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে?” এই অকপট স্বীকারোক্তি শুনে আকাশের সমস্ত প্রতিরোধ-ক্ষমতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে৷ এখন ওর মনে হচ্ছে, ও নিজেও তো কতদিন মেঘমালার কথা ভেবেছে। কিন্তু কখনোই নিজের মনোভাব নিজের কাছেই প্রকাশ করতে সাহস পায় নি। মেঘমালাকে দু হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয় আকাশ। বুঝতে পারে ওর জামা ভিজে যাচ্ছে মেঘমালার চোখের জলে। আকাশের চোখও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আকাশ মেঘমালার বাবার জন্য এখন আমেরিকায় যাবে না শুনে ওর বাবা- মা ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল।
আর দাদু ফিকফিক করে হেসে বলল,” ঈর্ষার থেকে ভালবাসার জোর অনেক বেশী। ” আকাশ তখন পুজোর সোনারোদে ভেসে যাচ্ছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।