জীবন মধুর গল্পে অমিতাভ রায়

জীবন মধুর

পাওলো কতদিন ধরে বেসমেন্টে আছে তা ও নিজেও জানে না। দিন- মাস- বছরের খবর ওর জানা নেই। ভাইপো- ভাইঝিরা দিব্যি আছে দেখে পাওলোর ভয় হয়ে গিয়েছিল। ও দাদুর মুখে শুনেছে মহামারী যখন হয়- তখন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয়। রবার্তো অকালেই মারা যাওয়ায় গোটা পরিবারের দায়িত্বই ওর উপর পড়ে যায়। রবার্তো বড় বেশী হুল্লোড়ে ছিল। অনিয়ম করতো। শরীরের দিকে কোন নজরই দিতো না। বউটাকেও খুব একটা পাত্তা দিতো না। তা সেই বউও কয়েক বছর আগেই মারা গিয়েছে। পাওলোর বয়স এখন সত্তর। ভাইপো- ভাইঝিগুলো বড় হয়ে গিয়েছে৷ বিয়ে থা করে সংসারি হয়ে গিয়েছে। এই মহামারির খবর পেয়ে দুটো ভাইঝিই বর-বাচ্চা সমেত পৈতৃক বাড়িতে চলে এসেছে। পাওলোর এখন আর হইচই পছন্দ হয় না। একটু নিরিবিলিতে থাকতে চায়। বিশেষ করে ওর মনে এখন ভয়ও ধরেছে। মৃত্যুভয়। ভাইপো-ভাইঝিরা এই ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ও পাচ্ছে না। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। বাচ্চাগুলোকে নিয়েও ঘুরছে। পাওলোর এক নাতনি লুনা ওকে বলেছে, এখানকার একজন মারা গিয়েছে। তার দেহে নাকি করোনা ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। আরো ভয় পেয়ে গেল পাওলো। দেখলো, এর পরেও এরা দিব্যি হইহই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাওলো ঘোষণা করলো, ও এখন থেকে বেসমেন্টেই থাকবে। সমস্ত শুকনো খাবার জোগাড় করলো। আর সঙ্গে নিলো বেশ কিছু ওয়াইনের বোতল। ভাইপো- ভাইঝিদের কোন আপত্তিই শুনলো না পাওলো। বেসমেন্টে একটা ছোট্ট বাথরুমও আছে। অসুবিধে হবে না। সঙ্গে নিয়েছে মিউজিক সিস্টেম- আর কিছু ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক। সময় দিব্যি কেটে যাবে। ওর প্রিয় বই ” ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দা সী” ও সঙ্গে নিল। এই একটা বই- যা কোনদিন পড়েও পুরনো হয় না।
প্রথম প্রথম বেসমেন্ট থেকে ও বোঝার চেষ্টা করতো ওপরে কি হচ্ছে। কিন্তু, পাওলো বিস্মিত হলো এটা বুঝতে পেরে যে এরা হইচই করেই সময় কাটাচ্ছে। ধীরে ধীরে ওর সব কৌতূহলই চলে গেল। সব ঠিক ছিলো। কিন্তু, ঘুম হতে চাইতো না। বিটোফেন- এর মুনলাইট সোনাটা পাওলোর খুব প্রিয়। যখন ঘুম আসতো না- তখনই মুনলাইট সোনাটা চালিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করতো। শুকনো খাবার আর রেড ওয়াইন – এই ছিলো ওর রোজকার মেনু। তবে সবই অল্প অল্প করে। অনেকদিন চালাতে হবে। যে বোতলটা ও বের করলো তার গায়ে barbera লেখা দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো পাওলোর। একটা রয়ে গিয়েছিলো তাহলে। এটা ছিলো সোফিয়ার খুব প্রিয়। পাওলোর বাবার নিজস্ব একটা বোট ছিল। সেই বোটে ও আর সোফিয়া প্রায়ই ঘুরে বেড়াতো। তখন অথৈ সমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে আলোকোজ্জ্বল নীল আকাশের তলায় রেড ওয়াইন খেয়ে সোফিয়ার কোলে মাথা রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে থাকতে কি ভালোই না লাগতো! একদিনের কথা ওর স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো। উতলা হাওয়ায় সোফিয়ার মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। ও সোফিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ” তোমাকে এইভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখবো চিরদিন। আর কোনদিন হারাবো না।” সোফিয়ার উচ্ছল হাসি সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্ছলতাকেও যেন লজ্জা দেবে। বৃষ্টির ফোঁটা ওদের সারা গায়ে মাখামাখি হয়ে গেলো। সেই সোফিয়া বিয়ে করে ফেললো! ও কয়েকবছরের জন্য ট্রেনিং নিতে এমেরিকায় গিয়েছিল। তার মধ্যেই এই কান্ড। তারপরে আর বিয়ে করা যায়! তবে ও পরে এটা জানতে পেরেছে সোফিয়ার বাবার মাছের ব্যবসায় টাকা ঢালতো ভ্যালেন্তিনো। ওর বাবার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ভ্যালেন্তিনো বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। এখনো সেসব কথা মনে পড়লে বুকটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে পাওলোর। এখন সোফিয়া কেমন আছে কে জানে?
কিছুদিন ওপর থেকে কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। একবার দেখবে নাকি? না- আর কয়েকদিন যাক। অবশ্য খাবার প্রায় ফুরিয়ে আসছে। এমনিতেই কয়েকদিন পরে বেরোতেই হবে। কয়েকদিন পরে পাওলো ভাবলো, এবার না বেরোলে ও আর বাঁচবে না। কিছু খাবার সংগ্রহ করতেই হবে। এই কয়েকদিনে ও আর কোনো আওয়াজই পায় নি ওপরে। শুধু একদিন যেন মনে হচ্ছিল কারা ধাক্কা দিচ্ছে বেসমেন্টের দরজায়। কোনো সাড়া দেয়নি পাওলো- দরজা খোলার চেষ্টাও করেনি। বহুদিন বাদে আজ দরজা খুলে বেরোলো পাওলো। কি আশ্চর্য! ওপরে কেউ নেই- একেবারেই ফাঁকা। নীচে নেমে সবেধন নীলমনি আধখাওয়া ওয়াইনের বোতল – আর অবশিষ্ট পাউরুটি আর জলের বোতল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পাওলো। দরজা খোলাই ছিলো। বাইরে মরুভূমির মতো। কেউ কোথাও নেই। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। অভ্যাস নেই তো! সামনে কি পড়ে! একটা কঙ্কাল! একটা কেন? ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটা কঙ্কাল পড়ে রয়েছে রাস্তায়। না,এদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। পাওলো পিছনে ফেরে। পাওলো বুঝতে পেরেছে ও যতক্ষণ আইসোলেসনে ছিলো ততদিনে ওই অঞ্চল শ্মশান হয়ে গিয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে কখন সমুদ্রের কাছে চলে এসেছে পাওলো খেয়ালও করেনি। খেয়াল হলো ভ্যালেন্তিনোর বাড়িটা দেখে। একবার দেখবে নাকি? ভ্যালেন্তিনো তো কবেই মরে ভূত হয়ে গিয়েছে। একটু ইতস্তত করে ঢুকেই পড়লো পাওলো। প্রাসাদোপম বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকে সামনেই লন। আগাছায় ভরে গেছে চারদিক। ভেতরে ঢুকে ঘরগুলোয় ঢোকে পাওলো। কেউ নেই- সব ফাঁকা। বেরিয়ে আসার আগে দারোয়ানের ঘরটায় একটা আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলতেই চমকে গেলো পাওলো। চেয়ারে বসে অর্থহীন চোখে সোফিয়া এদিকেই তাকিয়ে আছে। ” সোফি- সোফি” – পাওলো ডাকে। সোফিয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। চিনতে পেরেছে ও৷ চোখ দিয়ে জল ঝরছে। সোফিয়ার চোখের জল নিজের হাত দিয়ে মুছিয়ে দেয় পাওলো। ” চলো- বেরিয়ে পড়ো।” ” কোথায়?” ” এই মৃত্যুপুরী ছেড়ে যেখানে হোক। ” সোফিয়া নড়বড় করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। পাওলো হাত দিয়ে ধরে নেয় ওকে। সোফিয়ার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে পাওলো। যেতে যেতে পাওলো শুনলো সবাই ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে। এতো বড়ো বাড়িতে ভয়ে থাকতে পারবেনা বলে সোফিয়া দারোয়ানের ঘরে উঠে এসেছে। দারোয়ানও আগেই পালিয়েছিল। খাবারদাবার একেবারেই শেষ। এখানেই না খেতে পেয়ে মরতো সোফিয়া। পাওলো বলে,” আমি সবাইকে ছেড়ে আলাদা ছিলাম- আর সবাই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে! সে জন্যই কিন্তু দেখা হলো আমাদের- তাই না সোফিয়া? জীবন কি বিচিত্র!”
হাঁটতে হাঁটতে বন্দরে চলে আসে ওরা। সার বেঁধে বোটগুলো দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোকও নেই কোথাও। কি করবে ভেবে পায় না পাওলো। একটা বোটে উঠে ভালভাবে দেখে। বোটটা চলবে মনে হচ্ছে। সোফিকে বোটে তোলে ধরে ধরে। তারপর বোট ছেড়ে দেয়। পরিচিত শহর- বন্দর ছাড়িয়ে বোট গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। একটা সীগাল এসে বোটে বসেই উড়ে গেলো। এই প্রথম কোনো জীবিত প্রাণীকে দেখলো পাওলো। ঐ তো, একটা ডলফিনকেও দেখা গেলো মাথা তুলেই জলের নীচে অদৃশ্য হয়ে যেতে। পাওলো সোফিয়াকে বলে,” আর কোনো চিন্তা নেই সোফি।” রেড ওয়াইনের কিছুটা মুখে ঢেলে সোফিয়ার কোলে শুয়ে পড়ে ও। সোফিয়া ওর মাথায় হাত বোলায়। বলে, ” কোথায় যাবো আমরা পাওলো? ” পাওলো হাসতে হাসতে বলে, ” জীবনের সত্তরটা বছর কেটে গিয়েছে কোথায় আছি জেনেই- বাকি জীবনটায় তুমি সঙ্গে আছো- কোথায় যাবো তা জানার দরকার কি?” সোফিয়ার চোখ থেকে জল ঝরে ভিজিয়ে দিলো পাওলোর মুখ। পাওলো জানে সমুদ্র আর মানুষের চোখের জল নোনতা। ওর খুব ভালো লাগছে। জীবন থেকে আর কি পাওয়ার আছে পাওলোর! বুকের ভিতরটা খুশীতে কাঁদছে বোধহয়৷ ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে৷ যে দিকে চোখ যায় নীল সমুদ্র। সোফিয়ার হাতটা চেপে বুকের ওপর ধরে রাখে পাওলো। তারপর বলে, ” লা দলচে ভিটা- জীবন মধুর- বড়োই মধুর-তুমি যে সঙ্গে আছো সোফিয়া!” বোটের উপরে উড়তে থাকা একঝাঁক সীগালের ডাকের সঙ্গে মিশে যায় পাওলোর কথা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।