• Uncategorized
  • 0

গল্পবৈঠক ৩৪ এর গল্পে সাধন চন্দ্র সৎপথী

অস্তরাগ

প্রতিদিনের মতো আজও খুব ভোরে উঠেছে সুদেষ্ণা।কাল অনেক রাতে ঘুমালেও হাঁটার অভ্যাসই ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে।সুদেবের ঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল-তারপর থমকে দাঁড়াল।ভাবল-গতকাল রাতে যে রকম ঝগড়া হয়েছে আজ আর “আমি একটু হেঁটে আসছি-দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও”-বলতে যাওয়াটা ঠিক হবে কী?
সুদেষ্ণা সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল-“না, নিজে থেকে প্রথমে কথা বলতে যাওয়াটা ঠিক হবে না।কথা বলা মানেই হার স্বীকার করে নেওয়া।দু ‘চার দিন সাধ্য সাধনা করুক,তারপর একটু নরম হওয়া যেতে পারে।কিন্তু দরজা বন্ধ করার ব্যাপারটা কী হবে?”
ততক্ষণে সুদেষ্ণার হাঁটার সঙ্গিনী দল এসে হাজির হয়েছে।
সুদেষ্ণার সমস্যার সমাধান তাঁরাই করে দিল-“এখনই ঘুম থেকে উঠে বাড়ির আর কেউ তো বাইরে বের হবে না।তাহলে এক কাজ করতে পারো -দরজাটা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দাও।”
সুদেষ্ণা পাল্লা দুটো টেনে দিয়ে বলল-“কাজ নেই তালা লাগিয়ে-সকাল তো হয়ে আসছে;এমন কিছু ধন-সম্পদ নেই যে,চোর ঢুকে নিয়ে যাবে।চলো -“
প্রতিদিনের মতো আজও রাধিকাদি নানান মজার কথা বলে চলেছে-
হাঃ হাঃ, হো হো, হি হি হাসির রোল উঠছে।
হাসির ব্যবস্থাটি রাধিকাদিরই আমদানি।রাধিকাদি কোথায় যেন পড়েছিল-‘উচ্চ শব্দ করে হাসতে পারলে শরীর রোগমুক্ত হয়-প্রফুল্ল থাকা যায়,বার্ধক্যকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়।’
পরদিনই ঘোষণা করেছিল-“আজ থেকে পি এন পি সি পুরোপুরি বন্ধ।সবাই মজার মজার কথা বলব আর প্রাণ খুলে হাসব।”
সেদিন থেকে “হাঁটতে হাঁটতে হাসি”-কার্যকর হয়ে গেল।
সেই ট্রাডিশন আজও চলছে।
কিন্তু সুদেষ্ণা চেষ্টা করেও প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না আজ।
গত রাতের কথা বার বার মনের মধ্যে চলে আসছে।প্রশ্ন জাগছে – ওভাবে বলাটা কী ঠিক হল? এত কথা বলার পরও সুদেব তো তেমন কিছু বলেনি।
সুদেষ্ণা জানে-সংসারে কোনো সমস্যা ঘটিয়ে সুদেব লেখালেখি নিয়ে মেতে থাকে না।পাছে কারো ঘুমের অসুবিধা হয়,তাই পুব দিকে যে ছোট্ট ঘরটা আছে-বাইরের কেউ এলে থাকতে দেওয়া হবে বলে করা -সেখানেই লেখতে বসে।বাইরের তেমন কোনো লোকজন তো কোনোদিনই আসেনি।ছোট্ট একটা তক্তপোশ,চেয়ার-টেবিল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পড়ে থাকত। এখন ওটাকেই সুদেব লেখালেখি ও রাত্রিবাসের ঘর করেছে।
সুদেব অফিসে সারাদিন বসদের হুকুম তালিম করে;বাড়ি এসে সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করে।
তবে রাতের খাবার খেয়েই ঢুকে যায় ওই ঘরটায়।
আর সুদেষ্ণার আপত্তিটা এখানেই।রাত জেগে,শরীরের শক্তি ক্ষয় করে,ইলেকট্রিক বিল বাড়িয়ে গল্প লেখার কী দরকার?স্কুল-কলেজ থেকে লেখলেও নাহয় বোঝা যেত -অনেক দিনের অভ্যাস ছাড়তে পারবে না।চল্লিশ পার করে শুরু করার কী যে মানে হয়?এই বয়সে শুরু করে হবেটা কী?কথায় বলে না-“বল ,বুদ্ধি ,ভরসা -চল্লিশ পেরোলেই ফরসা।”
সুদেষ্ণার ভাবনা বাধা পেল রাধিকাদির কথায়।
রাধিকাদি বলছে-“এবার আমাদের হাসানোর পালা সুদেষ্ণার।”
সুদেষ্ণা নীরস কন্ঠে বলল-“আমাকে আজ ছাড় দাও,মেজাজ ভালো নেই।”
রাধিকাদি হাসিমুখে বলল-“মেজাজ ভালো নেই কেন?কর্তার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?”
-” ঝগড়া নয়,ওই লেখালেখি নিয়ে-”
রাধিকাদি বলল-“তুমিও হয়েছে সেইরকম!জানো তো-মানুষটা গল্প লেখতে ভালোবাসে-তার জন্য প্রতিদিন এত কথা শোনাতে যাও কেন?”
সুদেষ্ণা বলল-“গল্প লেখতে ভালোবাসে বলেই তো সহ্য করতে পারিনা।আমাকে ভালোবাসে না,ভালোবাসে গল্প লেখা!সংসারে তো অন্য কিছুই পেলাম না;একটু ভালোবাসা পেয়েছিলাম-সেটাও কেড়ে নিয়েছে গল্প।কার সহ্য হয় বল দেখি?”
রাধিকাদি হেসে বলল-“কার সহ্য হবে,না হবে না-জানিনা; তবে আমার সহ্য হতো।এরকম লেখক স্বামী পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার।”
সুদেষ্ণা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল-“আর ভাগ্যের ব্যাপার!এমন ভাগ্যে আমার কাজ নেই।ছেলে-মেয়ে ঘুমালে স্বামী-স্ত্রী দু’চারটা নিজেদের কথা বলব,ভাব-ভালোবাসা দেখাব-তা নয় গল্প নিয়ে বসে থাকে।গল্প তো নয়,আমার সতীন।কাল বলে দিয়েছি-এর একটা বিহিত দরকার-হয় তোমার গল্প থাকবে,না হয় আমি।”
সুদেষ্ণার রাগ দেখে দলের অনেকেই হেসে উঠল।
রাধিকাদি বলল-“লেখালেখি নিয়ে তুমি আর ঝগড়া করো না।ঝগড়া করাটা ঠিক হচ্ছে না।”
বাড়ি ফিরে সুদেষ্ণা দেখল-দরজার পাল্লা দুটি লাগানোই আছে।মনে মনে বলল-“তাহলে এখনও কারো ঘুম ভাঙেনি।”
ভেতরে ঢুকে আড়চোখে তাকাল সুদেবের ঘরের দিকে-দরজা হাট করে খোলা!তবে কী রাতে দরজা বন্ধ করেনি?নাকি উঠে বাইরে গেছে?অন্য দিন তো এই সময় ঘুম থেকে ওঠেনি!
একরাশ কৌতূহল নিয়ে সুদেষ্ণা এগিয়ে গেল।দেখল- বিছানা ফাঁকা!
সুদেষ্ণা দু-এক সেকেন্ড ভাবল -তারপর এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে।মনে মনে বলল-‘কাল কী লিখেছে দেখি-ফিরে আসার আগে পড়ে ফেলি।কোনোদিনই তো পড়া হয়নি।’
কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা খুলল।উপরের লেখাটাই  তুলে নিল।
ও মা, চিঠি লিখেছে যে! আজকাল চিঠির মতো করে গল্প লেখা চালু হয়েছে নাকি?ও মা, আমার নামই লিখেছে যে!দেখি কী লিখেছে!
“সুদেষ্ণা,
গতরাতে বুঝেছি -গল্প লেখার বিলাসিতা আমার মতো মানুষের শোভা পায় না।সত্যিই,আমি তোমার প্রতি অবিচার করছি।তোমাকে  কিছুই দিতে পারিনি।আমার গল্পগুলি দিলাম।জানি,তোমার কাছে এগুলির মূল্য তেমন নেই; কিন্তু আমার তো দেবার মতো আর কিছুই নেই।কথা দিলাম -আমি আর কোনোদিনই গল্প লেখব না।তোমাকে কষ্ট দিয়ে গল্প লেখতে চাই না।”
সুদেষ্ণা ডুকরে কেঁদে উঠল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।