গল্পকথায় সৈকত ঘোষ

নন্দিনী

ঝোলা গোঁফে হাত বোলাতে বোলাতে পালবাবু বহুদিন পর বীরের মতো বাড়িতে ঢুকলেন। হাতে একটা ফুলের বোকে, মিষ্টির হাঁড়ি, নতুন কে সি পালের ছাতা, আরও দুটো প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে।
তখন সন্ধ্যে হয়েছে। বাড়ির সবাই বাইরের দিকের ঘরে বসে চা আর মুড়ি খাচ্ছিল। বড়মেয়ে টুসি একগাল হেসে বলল, বাপরে বাপ, এতকিছু দিয়েছে? প্যাকেটে কী আছে বাবা?
ছোটমেয়ে লুসি এসব আলোচনায় তেমন উৎসাহ দেখাল না। প্যাকেট টা নিয়ে ফরফর করে ছিঁড়ে হতাশ হয়ে জানাল, ধূস, পাঞ্জাবি।
আজ পালবাবুর ফেয়ারওয়েল। সরকারী অফিসের বড়বাবু । শেষদিন অফিস করে সহকর্মীদের বিদায় উপহার নিয়ে এই বাড়ী ফিরলেন।
ছেলে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল। পালবাবু বাধা দিয়ে বাইরের দিকে ডাক দিলেন, নন্দিনী? কোথায় গেল?
গিন্নী এতক্ষণ যতটা সম্ভব উদাস থেকে চা খাচ্ছিলেন আর একমনে কী একটা মেগাসিরিয়াল দেখছিলেন। ছাতা পাঞ্জাবি ফুল এসব নিতান্ত জাগতিক ব্যাপার তাকে বিচলিত করেনি, কোন এক নন্দিনী র ভিতরে আসার আহবান এবার সত্যিই বিচলিত করল।
মেগা সিরিয়াল এর প্রভাবেই সম্ভবত, ডাক ছাড়লেন, কে? কে? কে?
নাতি বিল্টুও ঠাকুমার সাথে টিভি দেখছিল। সেও এই আলোচনায় কন্ট্রিবিউট করতে চাইল, ঠাম্মা, সেই গানটা কী যেন, কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি।
দেখিসনি কী এবার দেখাচ্ছি। কে এসেছে? নন্দিনী ? কে সে?
ছাতায় হেলান দিয়ে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে ছবি বিশ্বাস এর স্টাইলে বলেন পালবাবু, আমার সাথে অনেক বঞ্চনা হয়েছে, পারবে, পারবে ফিরিয়ে দিতে আমার তিরিশ টা বছর ?
পালবাবুর বঞ্চনাটা ঠিক কী, সেটা একটু জটিল আর বালখিল্য ও বটে। এক ছেলে দুই মেয়ে বৌমা নাতি নিয়ে পালবাবুর সংসার। ছোটবেলা গ্রামে কেটেছে। ছোট থেকেই পালবাবুর বিড়ি সিগারেট ইত্যাদি কোন নেশা নেই, বই পড়া, সিনেমা দেখা, ঘুরে বেড়ানো এসব ও কিছু নেই, আছে একটাই শখ, সেটা হল দুধ খাওয়া। গোরুর দুধ কতরকমভাবে কত বিচিত্র ভাবে এবং কত উৎকট ভাবে খাওয়া যায়, সেটা পালবাবুর কাছে শেখার। উনি অক্লেশে গ্লাসের পর গ্লাস দুধ খেয়ে ফেলতে পারেন, সারাদিন শুধু দুধ খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারেন, দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতোই। হেন খাবারের জিনিস নেই যেটা উনি দুধ দিয়ে খাননি, ভাত রুটি মুড়ি খই মায় লুচি পরোটা পর্যন্ত উনি দুধ দিয়ে খেতে ভালোবাসেন।
দুধের জন্য এই যে প্যাশন, পাড়ার লোক আড়ালে এইজন্য ওনাকে দুধকুমার বলে ডাকে।
দুধকাতর পালবাবুর জীবনে প্যাশন টাই এখন সমস্যা, নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে যেটুকু দুধ রোজ আসে, তাতে তিনকাপ চা খাবার পরে আর নতুন করে পালবাবুর বরাদ্দে কিছু জোটা বেশ কঠিন। আর বাড়ির বাকিরা এই নিয়ে এতটাই একজোট যে, রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার মতোই, গোটা পরিবার দুগ্ধপ্রকল্প নিয়ে পালবাবুকে বঞ্চনা করে চলেছে।
মাঝে অবশ্য উনি গুঁড়ো দুধ দিয়ে সমান্তরাল ব্যবস্থা চালু রাখতে চেয়েছিলেন। নানা কারণে সেটি ফ্লপ করেছে। এই বয়সে সবার সামনে বসে বাটিতে গুঁড়ো দুধ খাওয়া কিঞ্চিৎ লজ্জার, ঝোলা গোঁফের ব্যারিকেড টপকে এটা খাওয়া বেশ ঝামেলারও, খ্রিস্টমাস ট্রী তে বরফ পড়ার মতো দেখতে লাগে, সর্বোপরি হতভাগা নাতি বিল্টু, খুঁজে বার করে নিমেষে সাবাড় করে দেবে। তাছাড়া দুধের স্বাদ ঘোলে মিটলেও মিটতে পারে, কিন্তু গুঁড়ো দুধে মেটে না।
অতীত বঞ্চনার রেফারেন্স টেনে পালবাবু ডিক্লেয়ার করেন, আমি এখন স্বনির্ভর। বলেই ফের মিহি স্বরে ডাকেন, নন্দিনী ?
থামাও তোমার ফাটা রেকর্ড। মাদার ডেয়ারির ব্র‍্যান্ড অ্যামব্যাসাডর এসেছেন। আর তার সাথে এই সন্ধ্যেবেলায় একজন মেয়ে নিয়ে বাড়ি আসার মতলব কী? গিন্নী বুঝে উঠতে পারেন না কতটা রাগবেন আর কতটা হাহাকার করবেন।
নন্দিনী র ভিতরে আসার অপেক্ষায় কেউ বসে থাকে না। গিন্নীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সবাই হৈ হৈ করে বাইরে বেরিয়ে যায় রিটায়ারমেন্ট এর দিনে কী আবার গোলমাল পাকালেন পালবাবু তার হেস্তনেস্ত করতে।
মহিলাই। ফরসা, ছোটখাটো চেহারা, কুন্ঠিত মুখে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পালবাবু সস্নেহে ডাকলেন, নন্দিনী ?
নন্দিনী মুখ তুলে চাইল, বলল, হাম্বা।
গিন্নী তেলেবেগুনে জ্বলে বললেন, এই গোরুটাকে কোথা থেকে ধরে আনলে?
মুখ সামলে। ওকে গোরু বলবে না। ওর নাম দিয়েছি নন্দিনী।
মরণ। নিজের মেয়েদের নাম রেখেছে লুসি আর টুসি। আর গোরুর নাম নন্দিনী।
লুসি টুসি ফ্যাচফ্যাচ করে ওঠে।
একে কোথায় পেলে? দুধকুমার কে গিফট দিল বুঝি ফেয়ারওয়েল এ?
দাদু তোমাকে দুধকুমার বলছে। বিল্টু দাদুকে ম্যানেজ করার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। ওর অনেকদিন এর শখ কুকুর পোষার, এখন দেখছে গোরুটাও মন্দ নয়। বেশ নিরীহ। কামড়ায় না, পিঠেও বোধহয় চড়া যায়।
গিফট ? হা হা। শোন আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় আমি কিনেছি।
অ্যাঁ, মেয়েদের বিয়ে হয়নি এখনও আর প্রভিডেন্ট ফান্ড এর টাকা দিয়ে গোরু কিনলে? ছ্যা ছ্যা। অ লুসি অ টুসি এবার তোদের কী হবে।
লুসি টুসি আবার ফ্যাচফ্যাচ করতে থাকে।
বলি কোন হারামজাদা এটা গছালো তোমাকে?
কে গছাবে? আমি রীতিমতো প্ল্যান করে এই রামভরোসের খাটাল থেকে কিনেছি।
পাশে গোরুর গলার দড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রামভরোসে, হাওয়া গরম দেখে গিন্নী কে একটা সেলাম ঠুকে দেয়।
পায়চারি করতে করতে আর মেঝেতে ছাতা ঠুকতে ঠুকতে পালবাবু বলতে থাকেন এবার দেখা যাবে কে দুধকুমার। নন্দিনী যখন দুধ দেবে সারাদিন শুধু দুধ খেয়েই থাকব। কে আর তোমাদের পরোয়া করে। হেই রামভরোসে, যাও নন্দিনী কো উঠোন কে পাশ যে এক ছোটা ঘর হ্যায়, উসমে রেখে আও। এখন থেকে ওখানেই ও থাকবে।
হায় হায়। ঐ ঘরে গানের মাষ্টার গান শেখাতে আসে যে।
আবার ফ্যাচফ্যাচ। লুসি টুসির।
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। নন্দিনী দিব্যি আছে। রিটায়ারমেন্টের পর পালবাবু ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নন্দিনী কে নিয়ে। বাজারে গিয়ে ওর জন্য নানা রকম শাকসবজি একগুচ্ছ কেনেন, ফেরার পথে রামভরোসের থেকে ঘাস আর খড় নিয়ে আসেন। পালবাবুকে দেখলেই নন্দিনী ছটফট করতে থাকে।
তোর ক্ষিধে পেয়েছে নন্দিনী ?
নন্দিনী প্রবল বেগে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
আয় মা, আয়। সস্নেহে গলায় হাত বুলিয়ে দেন। পালবাবুর হাত থেকে খেতে থাকে নন্দিনী।
দুপুরবেলা আনমনে পালবাবু নন্দিনী র সাথে গল্প করেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ভারি শান্ত স্বভাব।
নন্দিনী র চোখটা পালবাবুকে খুব টানে। কেমন টানাটানা মায়াবী চোখ। হয়তো কথা বলতে পারেনা বলেই চোখ দিয়ে মনের ভাব বোঝায়। পালবাবু যখন গল্প করেন, নন্দিনীর চোখ দেখেই বুঝতে পারেন ও সব বুঝতে পারছে।
অনেকক্ষণ না দেখতে পেলে নন্দিনী অভিমান করে। ডাকলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। পালবাবু গায়ে হাত বুলিয়ে অনেক বুঝিয়ে মানভঞ্জন করেন। কী করব বল মা, আজ অফিসে পেনশন তুলতে গেলাম যে। নন্দিনী পালবাবুর গায়ে মুখ ঘষে দেয়।
খুব গরম পড়লে টেবল ফ্যান চালিয়ে দেন। এবার একটু আরাম লাগছে মা?
হাম্বা। আদুরে গলায় জানান দেয়।
পাল পরিবারে অনেকদিন পর শান্তির আবহ। পাল বাবু আর গিন্নী দুজনেই ব্যস্ত, যথাক্রমে নন্দিনী আর সিরিয়াল নিয়ে। কারো সাথে তেমন দেখাসাক্ষাৎ নেই, তাই ঝামেলাও নেই, রোজকার খিটিমিটিও নেই।
একদিন রামভরোসে প্রসঙ্গ তুলল। বাবু কদিন গোরুটা আমি খাটালে লিয়ে যাব।
কেন কেন
আপনি বাবু দুধকুমার এই জন্যেই আছেন। গোরুটার বাছুর আসবে কেমন লিয়ে?
তা বটে তা বটে।
রামের ভরসায় রামভরোসের খাটালে রেখে এলেন।
কয়েকমাস কেটে গেছে। এখন পালবাবু আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নন্দিনী গর্ভবতী। রামভরোসে মাঝেমধ্যে দেখে যায়। সারাদিন পালবাবুর নন্দিনী র পরিচর্যায় কেটে যায়। এখন ওর কত যত্নের প্রয়োজন, গিন্নী দাঁত কিড়মিড় করে বলেন, নিজের যখন ছেলেমেয়ে হল আমাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বাবু ঝাড়া হাত পা। আর এখন আদিখ্যেতা দেখ। এটা খাওয়াচ্ছে ওটা খাওয়াচ্ছে। এখনো কোন গাইনির ডাক্তার দেখায়নি এই অনেক।
ফ্যাচফ্যাচ। লুসি টুসি।
পালবাবু এসব টিটকিরি গায়ে মাখেন না। বরং বাচ্চা হলে এইটুকু ঘরে দুজন থাকবে কী করে সেই চিন্তা বেশি হয়।
নন্দিনী এখন প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পালবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কষ্ট হচ্ছে মা?
মায়াবী চোখে ঘাড় উঁচু করে চুপ করে তাকিয়ে থাকে।
অবশেষে একদিন সকালে সত্যিই নন্দিনী র একটা ফুটফুটে ছানা হল। মায়ের মতোই গায়ের রং, পিটপিট করে এদিক সেদিক দেখে বোঝার চেষ্টা করছিল কোথায় এসেছে, প্রথমে পা ছেতরে পড়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর দু একবার গোঁয়ারের মত দাঁড়াতে গিয়ে আছাড় খেল, তারপর বিল্টুকে অবাক করে দিব্যি ল্যাকপ্যাক করে উঠে দাঁড়াল।
পালবাবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কদিন খুব টেনশন এ ছিলেন। প্রসন্ন হাসি হেসে নন্দিনী র মাথায় হালকা করে হাত বুলিয়ে দিলেন।
পালবাবুর এখন দুজনের দায়িত্ব। নন্দিনী আর টিনটিন এর। এই নামটা বিল্টু দিয়েছে। টিনটিন বড় বিচ্চু হয়ে উঠেছে। তিড়িং বিড়িং করে ছুটে বেড়ায়।
পাল পরিবারে এখন অঢেল দুধ। রামভরোসেকে আর খাটাল থেকে দুধ দিতে আসতে হয় না। নন্দিনী এত দুধ দিচ্ছে যে বাড়ির সবাই মনের সুখে দুধ খাচ্ছে। দুধ নিয়ে বাড়িতে কারও কোন অভিযোগ আর নেই।
আর পালবাবু সেদিন থেকে দুধ খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন।

 

[আমার কথা –
আমি সৈকত ঘোষ। যারা আমাকে হাড়েহাড়ে চেনেন তারা জানেন আমি হাড়কিপটে হলেও সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে হাড়ের মেরামতি করি। হাড়কাঁপানো শীত হোক বা হাড়ে বাতাস লাগা গরম, কাজের ফাঁকে একটু আধটু লিখলে তবে আমার হাড় জুড়োয়। সেইসব হাড় হাভাতে হাড়গিলের লেখা পড়ে আপনারা আমাকে হাড়বজ্জাত ভেবে আমার হাড়গোড় না ভেঙে দেন, এই ভয়ে আমার হাড়হিম হয়ে আসছে।]

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।