গল্পকথায় সুব্রত ভৌমিক

পায়ের শব্দ

সম্পর্কটা আজ খুলবে। প্রেমিকা অপেক্ষা করবে এক বান্ধবীর ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটায় বাবা-মা কেউ থাকবে না আজ। সেইমতো সন্ধে ছ’টা নাগাদ দীপ্তর সেখানে পৌঁছনোর কথা। বান্ধবী দুজনকে একটা বেডরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে কাজের অছিলায় একটু দুষ্টু হেসে নিজেকে সরিয়ে নেবে। তারপর শুধু সে আর প্রেমিকা। সাথে সম্পর্ক। রাত দশটা অব্দি।
উফ্, ভাবতে গিয়ে দীপ্ত ঘেমে গেল।
এমন সময় ফোন বাজল, ‘কী, কিনেছ ওটা?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভাল কোম্পানি তো?’
‘আরে, হ্যাঁ হ্যাঁ।’
ফোনটা চুপ করে গেল।
বছর দেড়েকের প্রেম। সপ্তাহে দিন তিনেক দেখা হয়। ঈষৎ খসা আঁচলের মতো সম্পর্কটা মাঝে মধ্যে শুধু একটু ভ্রূ নাচায়, চোখ টেপে। তবে খোলে না৷ এভাবে প্রেমিকা আসে। আর যেদিন আসে দীপ্ত সারাটাদিন কিছু দেখতে পায় না। কোনও ভুখা মানুষের মিছিল, ডালে বসা পাখি, ঘরে ঢোকা জ্যোৎস্না৷ কানে হেডফোন গুঁজে শুধু রকসঙ্ শোনে। আর বাইক মোছে। আর রোদে জামা শোকায়৷ এরই মধ্যে ঠিক বেরোবার সময় মা’র হঠাৎ মৃদু ডাক, ‘খোকা, একটু বসবি?’
অমনি বিরক্তি, ‘ওফ্, আবার কী হল!’
‘কিছু না। দুটো কথা বলতাম। সারাক্ষণ তো একা থাকি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।’ খোকা ঝটতি আরেকবার ঘড়ি দেখল। দ্রুত চুল আঁচড়াতে লাগল।
জীবন ইদানিং এইরকম ব্যস্ত৷ ঘন ঘন ঘড়ি দ্যাখে। দু’দন্ড একাকী বিধবা মায়ের কাছে বসতে পারে না। বেশিক্ষণ থাকতে পারে না কোনও পথচলতি সঙ্গি, দিন ফেরত অন্তর, কিম্বা সন্ধের কোণে পড়ে থাকা অলক্ষ্য চাঁদের সাথে। তবুও একা মা যথাসাধ্য নমনীয়, ‘যা না বাবা, তোর মাসিকে একটু দেখে আয় না।’
‘এখন? খেপেছ!’
‘যাসই তো না। শুনলি এত অসুস্থ —।’ মা এবার চোখ নামাল। চোখে আঁচল চাপল। বুজে আসা স্বরে চাপা অভিমান।
দীপ্ত যেতে গিয়ে থমকাল।
কে থামাল, অনুভব? ভালবাসা কি আসলে এক অনুভতি? অতএব যেতে হল। দুড়দাড় বাইকটা বার করেই হাই-পিকআপ্। ঘড়িতে এখন বিকেল চারটে। যে করে হোক সন্ধের মধ্যে ফিরতেই হবে। প্রেমিকার সঙ্গে আজ তার —। অতএব ঘন্টায় ষাট-পঁয়ষট্টি, গাড়ি ছুটছে।
মাসির বাড়ি খোলাপোতা। গ্রাম্য, দোতালা, ছায়াময়। ঢোকার মুখে ছোট্ট চটার গেট। খানিক এগোলে বারান্দা। কড়া নাড়তে এক গ্রাম্য যুবতী দরজা খুলল। পাশের বাড়ি থাকে। জানাল, সে-ই সকালে ফোন করেছিল। মাসির অবস্থা ভাল না। গায়ে খুব জ্বর। এখন বেহুঁস। দীপ্ত এসে পড়ায় এবার একজন ডাক্তার ডাকা যেতে পারে৷ দরকারও।
সুতরাং তা-ই হল।
ডাক্তার এসে জ্ঞান ফেরাল। মাসি চিনতে পেরে হাসল৷ তারপর ফের চোখ বুজল। যেন এক গভীর ঘুমের দেশে ফিরে গেল ফের। এরই মধ্যে প্রেমিকার দু-দু’বার ফোন আসে, ‘কোথায়?’
‘এই তো, আসছি।’ দীপ্ত দ্রুত মোবাইল তোলে।
‘তাড়াতাড়ি এসো।’
‘আসছি আসছি।’
ফোনটা ফের হাসতে হাসতে থামে। অপেক্ষা করে।
মাসি তখন বাঁচার জন্য লড়ছে। ধুঁকছে। দিনের পর দিন একটা সম্পর্কহীন নিঃসঙ্গতার জন্যই নাকি এই রোগ। এমন রোগে পাড়ার দারুণ গাওয়া লোকটা আর গায় না। মিত্রি-বাড়ির তেতলার ছাদে ছাড়া নিঃসঙ্গ কুকুরটা রাতদিন অকারণ ডাকে, এই রোগেই। হঠাৎ-হঠাৎ সারা ছাদ দৌড়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে কার্নিসের উপর দিয়ে হাঁটে। অনেক নীচের রাস্তাটা দেখবার জন্য ভয়াবহ ঝুঁকে পড়ে। মাসিও কি এভাবেই কিছু দেখবার জন্য মৃত্যুর মতো এক অন্ধকার খাদের কিনারায় বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে পড়েছিল?
গ্রাম্য মেয়েটি বিছানায়। সাগ্রহে ঝুঁকে। হঠাৎই শ্বাসকষ্ট হওয়া মাসির মুখের মধ্যে মুখ পুরে শ্বাস ঢোকাতে লাগল। তারপর ‘মাসি … মাসি’ বলে যেন এক অভিমানী ঘুমন্ত জীবনকে প্রাণপণ ডাকতে থাকে। দীপ্ত কেমন শিহরিত হল। হঠাৎই তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। তার মা’ও কি সারাটা দিন এমন এক বোবা নিঃসঙ্গতায় ভোগে? মা’য়ের মুখটা ভেসে উঠতেই দীপ্তর হঠাৎ কেমন কান্না পেল। চিল্লে উঠতে ইচ্ছে করল। চোখের কোল কেটে বেরনো জলটা বাঁ হাত দিয়ে ঝটতি মুছে ফেলে মনে মনে ঠিক করল — না, আজ বাড়ি ফিরেই মা’র সঙ্গে খুব গল্প করবে। পাশে বসে কথা বলবে। তার অতীত শুনবে। ইচ্ছে শুনবে। এই যে প্রতিদিন বাঁচে, কী লাভ, যে-দিন স্মৃতি হয় না। স্মৃতিহীন বাঁচা যায়?
কিন্তু পরক্ষণে সে পাল্টাল। দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকাতেই এক লাফে বাইরে এসে ভাবল, একী! এদিকে তো তার দেরি হয়ে যাচ্ছে! সন্ধে ছ’টার মধ্যে যে তাকে ফিরতেই হবে। কথাটা মনে হতেই ফের সে ঘড়ি দেখল। তারপর ফের আসা প্রেমিকার ফোনটা ধরে এবার বলে উঠল, ‘ইয়ে শোন, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, সিচুয়েশানটা একটু বোঝার চেষ্টা করো—-‘
‘আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না! তুমি এক্ষুনি আসবে কি আসবে না তাই বল!’
‘বললাম তো আসছি।’
‘কতক্ষণ?’
‘এই তো, মিনিট চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ —‘
ফোনটা কেটে গেল।
কিন্তু না, জ্বরটা নামছে না। মাসি এখনও ঘুমের দেশ থেকে ফিরছে না। ডাক্তার এবার একটা ইনজেকশান পুস্ করে যাবার আগে দীপ্তর উদ্দেশ্যে বলে গেল, ‘চিন্তার কিছু নেই। বিপদ গেছে। তবে জ্বরটা না কমা পর্যন্ত একটু থেকে যান না?’
মানেটা কী! দীপ্ত ঝম্ খেপে গেল। এরপর সে ঠিক সময় পৌঁছবে কী করে? একটা ফাঁকা ফ্ল্যাটে আজ তার প্রেমিকা আসবে, সম্পর্কটা খুলবে, পকেটে সেইমতো—-। কিন্তু না, মাসি এখনও চোখ খুলছে না। মাসিকে এভাবে জ্বর-গা, অচৈতন্য, চোখবন্ধ অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যাবে? যাওয়া যায়?
প্রশ্নটায় সে মনে মনে বিব্রত হল। চট করে আরেকবার ঘড়ি দেখল। যেন কেউ জাগছে আজ, এভাবে ঘুমিয়ে থাকা নিজেকে একটু বোঝাল, ‘ঠিক আছে, দেখাই যাক না আরেকটু।’ বলে নিজেই নিজের কাছ থেকে যেন একটু সময় চেয়ে নিয়ে অগত্যা সে এবার দোতলার বারান্দাটায় গিয়ে খানিক দাঁড়াল। মাড়ি শক্ত, মুখ ভার। বারান্দার একটা ইজিচেয়ারে গা ফেলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর ধোঁয়াটা রিং করে ছুড়তে ছুড়তে আনমনে চারধারটার দিকে তাকাল।
দেখল, দিনটায় ক্রমশ সন্ধে লাগছে। দূরে কোথায় চলে যাওয়া এক ছায়াপথ। দু’ধারে মেঠো-বাড়ি, বাঁশতলা, ধানক্ষেত। পাখিরা দিনান্তে ফিরছে। তো তাজ্জব, এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দীপ্তর শরীর বেয়ে আচমকা কেমন একটা শিহরণ খেলে গেল। যেন একটা বন্ধ হলঘরের অজস্র জানলা খুলে যাচ্ছে৷ ফোকাসের মতো আলো ঢুকছে তাতে। আর তার একটা জানলায় ভেসে উঠল কবেকার ফেলে আসা এক সন্ধে। আর আরেক জানলায় উঁকি দিয়ে গেল খিলখিলিয়ে মিলিয়ে যাওয়া এক স্বপ্ন।
আশ্চর্য, এভাবে তো সে কখনও নিজের ভেতরটা এমন তাকিয়ে দেখেনি। চোখ তুলে দেখল, আকাশ তারাময়। সামনের বাঁশবাগানটার মাথার উপর ধীরে চাঁদ উঠছে। আর এমন একটা সময়ে গ্রাম্য মেয়েটি মুখের সামনে একটা কাপ-ডিস ধরে আস্তে বাজল, ‘চা।’
দীপ্ত চুমুক দিয়ে মুখ খুলল, ‘আপনার চোখ ভাল।’
‘কেন?’
‘সব দিকে নজর থাকে। ভাল দেখতে পান।’
‘আপনি পান না?’
‘কে জানে। সারাটাদিন নানা ধান্দায় ছুটি। হয়তো এড়িয়ে যায়।’
‘এমন ছুটতে হয় কেন?’
‘কেউ ছোটায়। ও হ্যাঁ, আপনার নামটা কিন্তু এখনও শোনা হল না।’
‘লতা৷
‘লতা!’
‘হ্যাঁ। ডাকনাম। বড় জড়িয়ে ধরে কিন্তু।’
দীপ্ত তাকাল। মেয়েটি দীঘল পাতার চোখদুটো আস্তে টেনে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। তারপর সেখান থেকে সহসা গান ভেসে এল, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে …।’ ওহ্, একী গলা! এ তো পাগল করে দেবে!
না, দীপ্ত আজ ফিরতে পারল না।
প্রেমিকা শেষ ফোনে জানাল, সে চলে গেছে। আর কোনও দিন ফিরবে না। দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। দীপ্ত ম্লানহাস্যে পকেটে হাত ঢোকাল। পকেটে লুকনো বস্তুটা বহুদূরে ছুড়ে ফেলল। কানে তখন বাজছে, ‘আমার এঘর বহু যতন কোরে …।’ বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদটা তখন আরও বড় হচ্ছে। মাথা তুলছে।
দীপ্ত কেমন সিরসিরিয়ে উঠল। জীবনে এই প্রথম সে জ্যোৎস্নাগ্রস্ত হল। চুপ করে এক চাঁদ-ওঠা দেখতে লাগল। না, আর কোনও তাড়াহুড়ো নেই। প্রেমিকা চলে গেছে। কিন্তু চারধারে কার পায়ের শব্দ! কার শ্বাস গায়ে লাগছে তার! কে এসেছে, কে!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।