ঢাকা শহরে এসেছেন শ্রী দিলীপ কুমার রায়| তখন বিজ্ঞানী সত্যেন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক| তাঁর বাড়িতে গানের আসর বসেছে| উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীকে সুরসাগরে ডুবিয়ে ভাসিয়ে যখন বিরতি নিলেন দিলীপ রায়, স্বাভাবিকভাবেই শ্রোতারা উঠে পড়েছেন, বিদায় নিতে উদ্যত, এরপর আর কে গাইবে? এমন সময় সত্যেন্দ্রনাথ সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, “আরে বসুন, বসুন, এবার ঘরোয়া আসর হবে”, তারপরেই সেই অনুষ্ঠানের শ্রোতারূপে উপস্থিত এক কিশোরীকে ডেকে হারমোনিয়ামটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন, বললেন “পালালে হবে? তোমার গান শুনবো না?”সেই কিশোরীটিই হলেন রানু, রানু সোম, ততদিনে যথেষ্ট সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে তার গানের| তারপরে শুরু হলো রানুর গান, শুনে আপ্লুত দিলীপ রায়| তিনি সেই কিশোরীকে গান শেখাতে চাইলেন| ঠিক হলো যত দিন দিলীপ রায় আছেন, বাবার সাথে প্রাত:ভ্রমণ করতে করতে রমনাতে সত্যেন বোসের বাড়ি এসে গান শিখে যাবে রানু|এই ভাবে শুরু হলো, কিন্তু গান শেখানো কেবল মাত্র সত্যেন বোসের বাসায় সীমাবদ্ধ রইলো না| দিলীপ রায় প্রায়ই চলে আসতেন রানুদের বাড়ি, রানুর মায়ের হাতের মাছের পাতুরিটি ছিলো তাঁর বড় প্রিয়| রানুকে তিনি শেখালেন তাঁর পিতা ডি. এল.রায় সহ অনেকের গান, তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, দিলীপ রায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু, কাজী নজরুল ইসলামের গান|রানু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতে লাগলো সেই গান| সেই অঞ্চলে একটা সাড়া পড়ে গেলো| কাজীর গান শুনে মাতোয়ারা আট থেকে আশি সব্বাই|
কিছুদিন পরে চলে গেলেন দিলীপ রায়|রানুকে আর কে শেখাবে কাজী সাহেবের গান? এমন সময় একদিন সন্ধ্যেবেলা রানুদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো এক ফিটন গাড়ি, সেই গাড়ি থেকে নামলেন সাধারণ গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে অতিশয় সুস্থ ও সুশ্রী এক ব্যক্তি| দরজা খুলতে এলো স্বয়ং রানু| তাকে দেখেই কোন ভূমিকা না করেই বললেন, “এই তো, তুমি নিশ্চয় রানু, মন্টুর ছাত্রী”(মন্টু দিলীপ রায়ের ডাকনাম), রানুর তখন উত্তেজনায় মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, “আপনি – আপনি কি….” “আমি নজরুল ইসলাম” বলেই হা হা করে দিলখোলা হাসি| সেদিন রানুর গান শুনে কি খুশী নজরুল, “আরে, সবাই বলছে ওর জন্য আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি…”, রানুর বাবা মা কে বলছেন নজরুল| পরদিন সকালেই আবার রানুর বাড়ি এসে হাজির কাজী, “সারারাত ধরে একটা গান লিখেছি, এক্ষুনি শিখে নাও”, রানুর ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা ছিল, ও অতি কম সময়ে গান তুলে নিতো, কথাও ভুল হতো না| এভাবেই প্রথম দিনে শেখা হয়ে গেলো, “আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী, সে কোন সোনার গাঁয় ”| কদিন পর আবার লিখে আনলেন, “এতো জল ও কাজল চোখে, পাষাণী, আনলে বল কে”| এই ভাবে মাস দেড়েক চলল রানুকে গান শেখান| রানুকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন কাজী নজরুল,
“মাটীর উর্দ্ধে গান গেয়ে ফেরে
স্বরগের যত পাখী
তোমার কন্ঠে গিয়াছে তাহারা
তাদের কন্ঠ রাখি
যে গন্ধর্বলোকের স্বপন
হেরী মোরা নিশিদিন
তুমি আনিয়াছ তোমার কন্ঠে
তাদের মুরলীবীন”….
তবে নজরুলের চলে আসার আগে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছিলো| সেদিন সন্ধ্যেবেলা রানুদের বাড়িতে এক সান্ধ্য আসর বসে নজরুলের গান ও কবিতা নিয়ে| শেষ হতে একটু দেরী হয়ে যায়| রাতের খাবার খেয়ে নজরুল যখন রানুদের বাড়ি থেকে বেরোন, তখন দশটা বেজে গেছে| কিছুদূর যাওয়ার পর কিছু দুষ্কৃতী নজরুলকে পিছন থেকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে| কিন্তু নজরুলও যুদ্ধ ফেরত সৈনিক, হাসি মুখে জেলে যাওয়ার মতো বুকের কলিজার অধিকারী, তাঁকে কাবু করা অত সহজ!? লাঠি কেড়ে নিয়ে উল্টে একজনকে ঘায়েল করেন, আর ক্রমাগত লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে হুঙ্কার দিতে শুরু করেন, বেগতিক দেখে সড়ে পড়ে দুষ্কৃতকারীরা| অন্যদিকে, নজরুল বাড়ি থেকে বেরোনোর পর কয়েকটি যুবককে পিছু নিতে দেখে রানুর বাবা উদ্বিগ্ন হন, তিনি একটি সাইকেল নিয়ে নজরুলকে সাবধান করে দিতে ছোটেন,যতক্ষণে তিনি অকুস্থলে পৌঁছন, ততক্ষণে নজরুল শত্রুদের ঢিট করে ফেলেছেন, কিন্তু রানুর বাবা আর নজরুলকে যেতে দিতে চান নি, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চোটের শুশ্রষা চলে সারা রাত| আসলে প্রানোচ্ছল মানুষটির নিজের মনে কোন সংকীর্নতা ছিলো না, আর অপরের সংকীর্ণতাকে পাত্তাও দিতে চাইতেন না|
এরপর রানু ঢাকা থেকে কলকাতা আসে গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়, নজরুলের গানই তিনি রেকর্ড করেন| রানুরা কলকাতা এলে চুঁচুড়াতে পিসির বাড়িতে উঠতো| সেখানে এসেও নজরুল গান শেখাতেন| সেখানে এসে রাত জেগে নজরুল লিখে ফেললেন এক কীর্তন,
“ কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া, কাঁদিয়া গো
যত ভুলি ভুলি করি, তত আঁকড়িয়া ধরি
তত মরি সাধিয়া সাধিয়া গো….”
রানুরা কলকাতায় গেলে তাঁদের ঠিকানা হতো নলিনীকান্ত সরকারের বাড়ি, যিনি ছিলেন নজরুলের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী, সেখানে প্রায়ই হানা দিতেন দাদা ঠাকুর শরত পণ্ডিত| গানে গল্পে আড্ডায় হই হই লেগেই থাকতো সারাদিন|
নজরুলের ও নালিনীকান্তের ঐকান্তিক ইচ্ছেতে রেডিওতে নজরুলের সঙ্গীত পরিবেশন করেন রানু, ততদিনে রেকর্ডও বেড়িয়ে গেছে| রানুর সময় থেকেই গ্রামোফোন কোম্পানির ট্রেনার রূপে নিযুক্ত হন নজরুল, এর পর তিনি ট্রেনিং দিতে শুরু করেন আঙুরবালা, ইন্দুবালা দের| রানুরা ঢাকা ফিরে আসে|
এর দেড় বছর পর রানু আবার কলকাতায় আসে গান গাইতে| আবার দেখা হয় নজরুলের সাথে, কিন্তু এ কী? সেই হাসিখুশি প্রানোচ্ছল মানুষটা কোথায় গেলো? এ তো সেই আগের মানুষটার ছায়া মাত্র! বললেন গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর সব সময় নিয়ে নিচ্ছে|সেবার রানু রেডিওতে গান গেয়ে বেরোচ্ছে, দেখে, চাদর লুটিয়ে কাজী দাঁড়িয়ে আছে, বুক ভরা অভিমান, “কী আশ্চর্য! শেষে অন্য লোকের মুখে আমায় জানতে হলো যে রেডিওতে তুমি গান গাইছো?” বাস্তবে রানুর কাছে কোন জবাব ছিলো না|
এর কয়েক বছর পর, তখন রানু আর ছোট্টটি নেই, ঢাকা ইউনিভার্সিটির অন্যতম সেরা ছাত্র, বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে তিনি তখন প্রতিভা বসু, কলকাতায় বসতি স্থাপন করেছেন দুজনে| ঢাকা রেডিও স্টেশন উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকার পথে রওনা দিতে ট্রেনে চেপেছেন দুজনে, দেখেন উল্টোদিকের বেঞ্চে বসে স্বয়ং কাজী নজরুল, মৃদু হেসে বললেন, “এ রকমই হয়”| রানু ওরফে প্রতিভা তো কিশোরীর মতো উচ্ছ্বসিত, কত কথা বলে চলেছেন, একটু পর বুঝতে পারলেন, কাজী কিছুই শুনছেন না| কি রকম একটা অন্যমনস্ক ভাব| আসলে, প্রিয়তম পুত্র বুলবুলের মৃত্যু শোক কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেন নি| ট্রেন থেকে নামার আগে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন অন্যমনস্কতার জন্য|এর কয়েক বছর পরে, চিরদিনের মতো নীরব হয়ে যান কবি, রেখে যান সহস্রাধিক গান ও কবিতা, আর রেখে যান অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত, যাদের হৃদয় দ্রবীভূত হয়েছিলো ওঁর উষ্ণ আলিঙ্গনে|
(তথ্যসূত্র: জীবনের জলছবি, প্রতিভা বসু, আনন্দ, এবং দেশ পত্রিকায় বেরোনো প্রতিভা বসুর স্মৃতি চারণ “স্মৃতি সতত সুখের”)