• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় রণজিৎ গুহ

প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী। নিয়মিত কিছু লিখিনা। মাঝেসাঝে ইচ্ছে চাগিয়ে উঠলে যেমনটা যা হয়। বয়স ইতিমধ্যেই ৭৬। দিব্যি আছি।

পাসওয়ার্ড

অনিন্দ্যর কাছে ফোনে খবরটা পেয়েই রোহিতের বাবাকে দেখতে নার্সিং হোমে পৌঁছে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি রোহিতের স্ত্রী সুলগ্না সাজানো গোছানো লাউঞ্জে দামী কৌচে বসে অন্য এক মহিলার সাথে দিব্যি জমিয়ে গল্প করছে। আমি কাছে গিয়ে গলায় উদ্বেগ ঢেলে জজ্ঞাসা করি,’কাকাবাবু কেমন আছেন?’ ‘আরে রণজিৎদা কতদিন পরে দেখা।তুমিতো আজকাল একেবারেই যোগাযোগ রাখো না।এসো না বাবা একদিন মধুমিতাকে নিয়ে।কতদিন ওর গান শুনিনি’।আন্তরিক হয়ে ওঠে সুলগ্না।‘না মানে…….হ্যা আচ্ছা যাব একদিন।রোহিতের বাবা কেমন আছেন?’
‘ঠিক করে কিছু বলা যাচ্ছে না।ডাঃ বাসু দেখছেন।উনি তো বলতে গেলে এখন ইণ্ডিয়ার নাম্বার ওয়ান। বছরে ছমাস বিদেশেই থাকেন আসলে আমার মাসতুতো দাদার এক বন্ধুর সাথে ওনাদের ফ্যামিলি রিলেশন। আমাদের ইরিগেশন মিনিষ্টারের মেয়ের ট্রিটমেন্ট তো ডাঃ বাসুই করেছেন।দাদার ফিল্ম লাইনে খুব চেনাজানা।নিজেই এবার একটা সিরিয়াল প্রোডিউজ করবে বলছে।আমাকেও একটা রোল নিতে বলছে’।আমি আরও একবার রোহিতের বাবার খবর জিজ্ঞেস করি।‘ডাক্তারবাবু অসুখটা কি বলছেন’?
সুলগ্না ঘাড় নাড়ে—‘না না এখনই কিভাবে বলা যাবে?নানা রকম টেস্ট চলছে।এক্সপেন্সিভ তবে খুব জেনুইন। আর অন্য কোথাও টেস্ট এরা করতেও দেবেনা।ডাক্তারবাবুরা অন্য ডাইগোনস্টিক সেন্টারের টেস্ট রেজাল্ট মানতেই চাইবে না।এদের রুমগুলো ওয়েল ফারনিসড।দারুন ডেকোরেটেড।পর্দার কাপড়, অল লিলেন সব ইমপোর্টেড।ইন্টেরিওর ডেকেরোটের দিয়ে ডিজাইন করা। পার ডে বেড চার্জ মিনিমাম ১১৬০০ টাকা প্লাস ঐ কিসব সার্ভিস চার্জ টার্জ আছে।আমরা অবশ্য ওই মাসতুত দাদার জন্য ফাইভ পার্সেন্ট অফ পাচ্ছি।এদের লাউঞ্জটা দেখেছ?পেশেন্ট পার্টির জন্য চমৎকার ব্যবস্থা।নমিনাল হাজার বারোশো পেমেন্ট করলে লাউঞ্জের মধ্যেই তুমি ২৪ ঘন্টার জন্য সেপারেট ক্যুপ নিতে পার।ভাবা যায়!কেউ কেউ মিসিউজ করে অবশ্য।কোনো কোনো কাপল মানে বুঝতেই পারছ….’।
আমি আবারও খোঁজ নিই ‘কাকাবাবুর প্রবলেমটা কী?কি হয়েছিল? নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হোল কেন’?
‘ওই একটা এটাকের মত আরকি।ভাগ্যিস নতুন গাড়ীটা ছিল। আর বলো কেন,সেদিন আমাদের ড্রাইভারটা আবার আসেনি। আমি তো রোহিতকে চালাতে দেব না।যদি টেন্সড হয়ে যায়।শেষে পাড়ার একটা ছেলে ড্রাইভারি করে,তাকে ডেকে দাদার বাড়ী গিয়ে,ডাঃ বাসুর সাথে যোগাযোগ করে তার পরে এই নার্সিং হোমে ভর্তি।এখানে আসতেই এক ইয়ং ডাক্তার বলে কিনা সঙ্গে সঙ্গে আনলেন না কেন? বোঝ!হুট করলেই আনা যায় নাকি? কার রেফারেন্স ছাড়া এখানে ভর্তি করবে?আর আমি আজে বাজে নার্সিং হোমে যেতে পারবনা বাবা।পাড়া প্রতিবেশীরা কি ভাববে বলতো’?

আমি কাকাবাবুর খবরটা ঠিক বুঝতে না পেরে রোহিতের খবর জিজ্ঞেস করি—‘রোহিত কোথায়’?
‘ও ছেলেকে নিয়ে পার্লারে গেছে’।সুলগ্না জবাব দেয়।
‘পার্লারে? মানে’?
আমার বিষ্ময় সামলে সুলগ্না বলে,’ছেলেটা এত বায়না করছিল আইসক্রীম খাওয়ার, তাই রোহিত ওকে নিয়ে লিণ্ডসেতে গেছে আইসক্রীম পার্লারে। ওখানে সুইডেনের একটা কোম্পানী পার্লার দিয়েছে জানোতো?ওদের ইন্টারন্যাশনাল চেইন।ওয়ার্লডের সেকেণ্ড বেস্ট আইসক্রীম ফার্ম।ইণ্ডিয়ায় শুধু বরোদা আর কলকাতায় আউটলেট আছে।দেখ মাঝরাস্তায় আবার কি বায়না ধরে’।
রোহিতের বাবার খবরাখবর না পেয়ে রোহিতের ছেলের খবর জানতে চাই।‘ছেলে কত বড় হোল?’
‘এইতো নেক্সট জুনে দুই কমপ্লিট হবে।ওকে মরিশনের কাছে দিলাম।দারুণ এটমস্ফিয়ার।ওনার তিনতলা ফ্লাটের গ্রাউণ্ডফ্লোর পুরোটাই প্রি প্রিপাটরি লোয়ার নার্সারির জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।এত হেলদ কন্সিয়াস ,বলার না।ন্যাপি থেকে সব কিছু ব্র্যাণ্ডেড চাই।তবে সুবিধা যে উনি নিজেই সব সাপ্লাই করেন।আমাদের আর এখানে ওখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়না।মাসে ১৩ হাজার নেন। কিন্তু সেটা সার্থক রণজিৎদা’।
‘কাকাবাবু কত নম্বর বেডে আছেন?’ আমি জানতে চাই।‘দেখা করা যাবে?’
‘ওরে বাবা! রিসেপশনে কথা বলো। ওরা যদি পারমিশন দেয়।ওদের কাছেই বেড নাম্বার পাবে।কফি খাবে?এদের অর্ডার দিলেই পাঠিয়ে দেয়’।
রিসেপশনে রোহিতের বাবার নাম বলতেই কম্পিউটর সামনে নিয়ে বসা সুবেশা মাঝ বয়সি মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনার আইডেন্টিফিকেশন??’
‘আমার বন্ধুর বাবা’
‘পাসওয়ার্ড বলুন’
‘পাসওয়ার্ড!’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।
আমার বিষ্ময় দেখে মহিলা বললেন ‘আমাদের এখানে তো সবাই ভি আই পি।তাই পেশেন্ট পার্টিকে আমরা একটা পাসওয়ার্ড দিই। পাসওয়ার্ড ছাড়া পেশেন্টের কোন ইনফর্মেশন আমরা কাউকে দিইনা’।
পাসওয়ার্ড না থাকায় আমি রোহিতের অপেক্ষায় অল এসি লাউঞ্জের পাশে শ্বেতপাথরের তৈরী জনার্দন মন্দিরের আরতি দেখতে থাকি।পাসওয়ার্ড না জানা থাকায় আরও অনেক পেশেন্ট পার্টি রোগীর ভালোমন্দর জন্য জনার্দনের শরনাপন্ন হচ্ছেন।তিনটে সুগন্ধ ধুপকাঠি,একটা স্টেইনলেস স্টীলের ছোট প্রদীপ,একটা শ্বেত পদ্ম ও খানিকটা খোয়াক্ষীরের সুদৃশ্য ডালি ১০১টাকায় বিক্রি হচ্ছে।পুরোহিতকে ২১ টাকা দক্ষিনা দিলেই রোগীর আরোগ্য কামনায় জনার্দনের কাছে নিবেদন করা হবে।পাসওয়ার্ড থাকলে,ডাক্তার বাবুর অনুমতি নিয়ে ঐ খোয়াক্ষীর রোগীকে খাওয়ালে নাকি চমকপ্রদ ফল পাওয়া যায়।

আরতি শেষ হওয়ার আগেই রোহিত ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসে।‘কী রে রণজিৎ,তুই এখানে? কী ব্যাপার,কেউ ভর্তি নাকি?’
‘আমি অনিন্দ্যর কাছে খবর পেয়ে এসেছি।তোর বাবা কেমন আছেন এখন?’
‘আর বলিস না।কি ঝামেলায় যে ফেঁসেছি!ক’দিন লাগবে কেজানে?অফিস থেকে সোজা এখানে চলে আসি।সুলগ্নাও দুফুর দুফুর ছেলেকে নিয়ে এখানে চলে আসে।আদারওয়াইজ যায়গাটা তো খুব কম্ফর্টেবল। কত স্পেসাস দেখেছিস?’
‘তোর বাবা কেমন আছেন এখন?’
‘এটা বলা মুস্কিল।ভি ভি আই পি হলে রোজ একটা বুলেটিন বের করে।অন্যদের জন্য যেরকম এডভাইজ করা থাকে।রোজ ,অল্টারনেট ডে বা উইকলি টোয়াইস একটা করে প্রিন্ট আউট দেয়।প্রতি প্রিন্ট আউটের জন্য ৬০০টাকা করে নেয়।আমরা অল্টারনেট ডে নিই।তাতে কি কি টেস্ট করা হয়েছে,আর কোন কোন টেস্ট করা হবে,বিভিন্ন টেস্ট রেজাল্ট কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে,কোন কোন ডাক্তার দেখেছেন সব লেখা থাকে।প্রেস্ক্রাইবড মেডিসিন এণ্ড ইঞ্জেকশন।এটেণ্ডিং সিস্টারের নাম,টিল ডেট কত বিল হয়েছে,কবে ক’টার মধ্যে টাকা জমা দিতে হবে—সব খুঁটিনাটি দেওয়া থাকে।এমনকি রোগীকে স্নান করানো হয়েছে কিনা,পোষাক পালটানো হয়েছে কিনা,লিনেন চেঞ্জ করেছে কিনা এসবও লেখা থাকে’।
‘কিন্তু রোগী কেমন আছেন,তার কি হয়েছে এসব লেখা থাকেনা?তাহলে তোরা কাকাবাবুর বর্তমান অবস্থা জানবি কি করে?’আমি জানতে চাই।
‘ওহো! তুই ব্যাপারটা বুঝছিস না কেন?টেস্টগুলো সব না হলে অসুখটা বোঝা যাবে কিভাবে?শরীরে হাইড্রোজেন নাইট্রোজেন কোনটা কত কম বেশী না জানলে ট্রিটমেন্ট করবে কিভাবে?’
‘তাহলে কাকাবাবুর কি অসুখ তা জানতে আরও সাত দশদিন লেগে যাবে?’
‘তা হতে পারে।আর অসুখের নামটা জেনে তো আমাদের কোনও লাভ নেইরে বাবা।রোগীর ঠিক চিকিৎসা হচ্ছে কিনা সেটাই জরুরী।সে ব্যাপারে এখানে তো বেস্ট।টপ ভিআইপিরা সব এখানে আসে।শুধু আমাদের দেশ নাকি বাংলাদেশ, আবু ধাবি থেকে এসে এখানে ট্রিটমেন্ট করায় ভাই’।
‘তা হলে রোগ ধরা পরার আগেই যে সব ওষুধ ইঞ্জেকশন চলছে সেগুলো কোন অসুখ সারাবার জন্য?’ আমি বেকুবের মত রোহিতের কাছে জানতে চাই।
রোহিত হঠাৎ তটস্থ হয়ে যায়।কয়েক সেকেণ্ড পর আঙুল দিয়ে দেখায়,ঐ যে ডাক্তারবাবু কে জানিস?এখন এসিয়ার মধ্যে নাম্বার ওয়ান গাইনোকলজিস্ট।এই গতমাসে ডুসেলডর্ফে পেপার পড়ে এলেন।একটা ডেলিভারী কেসে শুধু নিজের ফিজই নেন ৭০০০০টাকা।
আমার কেমন অবাক লাগে।এসিয়ার নাম্বার ওয়ান বা টু কারা ঠিক করে?ওয়ান টু থ্রী যাই হোক এনাদের হাতে একটাও নরমাল ডেলিভারি হয়েছে বলে তো শুনিনা।এখানে আসলেই ব্যাপারটা জটিল হয়ে যায় নাকি শুধু জটিল কেস গুলোই এখানে আসে?হতে পারে এখানে যারা ভর্তি হতে চায় তারাই নানা জটিলতার শিকার।অথচ আমার ছোড়দি বত্রিশ বছর টাকী গ্রামীন হাসপাতালে চাকরী করছে।এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র দুটি কেস সিজারের জন্য জেলা হাসপাতালে পাঠিয়েছে। বাকী সব স্বাভাবিক প্রসব।সুলগ্না আমাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে। রোহিত হাসি ছড়িয়ে সুলগ্নাকে বলে—‘রণজিৎ এর দিদির হাতে নাকি সব নরমাল ডেলিভারি’।সুলগ্না বুঝতে না পেরে বলে-‘কার ডেলিভারি হোল?’
‘আরে না ওর দিদির হাসপাতালে কোন সিজারিয়ান কেসই নেই’
বিষ্ময় ছড়ায় সুলগ্নার ভ্রুতে-‘তাই! উনিতো সুন্দরবন অঞ্চলের ওদিকে কোথায় যেন আছেন তাইনা?আর ট্রান্সফার নিলেন না।এই তোমরা কফি খাবে? আমি বলে দিচ্ছি।সুলগ্না ছেলে বুঙ্কাইকে স্যাণ্ডুইচ খাওয়াতে নিয়ে যায়। আমি আর রোহিত কফি নিয়ে জনার্দন মন্দিরের সামনে লতাপাতা আঁকা পাথরের বেঞ্চিতে বসি৷

কফি খেতে খেতে রোহিতের কাছে জানতে চাই ‘তোর মা মানে কাকীমা আসেননি?’
‘ঐ সেদিন বিকেলে এসেছিল। তারপর আর আসেনি’।
‘সে কি কেন’?
রোহিত উদাসীন গলায় বলে—‘মার বক্তব্য হচ্ছে,এখানে এসে মানুষটাকে দেখতেই না পেলাম,একটু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে না পারলাম,তাহলে শুধু শুধু এসে লাভটা কি?শুনেছি ওরা পেশেন্টের সাথে লাউঞ্জে একটা ভয়েশ চ্যাট এর ব্যাবস্থা করবে।তাছাড়া জায়ান্ট স্ক্রীনে তুমি পেশেন্টকে দেখতেও পাবে।দু তিন মাসের মধ্যে প্রজেক্টটা শেষ হবে। টিল্ল দ্যাট টাইম বর্তমান অবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি? রেপুটেশন আছে। পেশেন্টের ঘরে আউটসাইডার ঢুকলে ইনফেক্ট হওয়ার রিস্ক আছে।একটা রেস্ট্রিকশন একটা ডিসিপ্লিন তো জরুরী।শুনছিস না কত জায়গায় পেশেন্ট পার্টি হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিচ্ছে’।
‘তাহলে তোরাই বা রোজ এখানে আসিস কেন? একদিন পর পর প্রিন্ট আউট নিয়ে নিলেই হয়।‘ আমার জিজ্ঞাস্য।
রোহিত পট জবাব দেয়—‘বাঃ আত্মীয়স্বজনরা আসে। বন্ধুবান্ধব তোরা আসিস।রিসিভ করতে হব না? সামাজিক দায় কি অস্বীকার করা যাবে বন্ধু?’
অসুস্থ কাকাবাবুর খবরাখবর তেমন জানতে না পারলেও অনেকদিন পর রোহিত ও সুলগ্নার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা তো হোলো।‘চলিরে রোহিত।আবার সেই অশোকনগরে ফিরতে হবে’।
‘দূর। থেকে যা তো আজকে।কতদিন পরে দেখা হোল।আমার কাছে একটা ইম্পোর্টেড স্কচ আছে।চল খুব জমবে’।রোহিত আন্তরিক আমন্ত্রন জানায়।
‘নারে আজকে না।কাল ছুটির দিন। হাটবাজার আছে। অন্য একদিন হবে’।আমি এড়িয়ে যাই।এর মধ্যে সুলগ্না বুঙ্কাইকে নিয়ে কাছে আসে।রোহিত আবার জোর করে-‘রণজিৎকে আজ থেকে যেতে বলছি ও না না করছে’।সুলগ্না রহিতের সাথে সুর মেলায়-‘থেকে যাও না রণজিৎদা।রাতে চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে।আমি তো চিকেন বিনফিক্স আর টমরট হরর এর অর্ডার দিয়েই এসেছি।ফ্যান্টাস্টিক বানায় বজঅন জয়েন্টটায়।থেকে যাও থেকে যাও।গেস্ট রুমটা খালিই পরে আছে।আমি ফোনে আরেক প্লেট এক্সট্রা দিতে বলে দিচ্ছি।তুমি একজাক্টলি যে টাইমে চাইবে নাইন থার্টি,টেন থার্টি ওরা অন ডট ডেলিভারি দেবে।ইয়েস নরমাল ডেলিভারি নো সিজারিয়ান।বিলিভ মি’। নিজের রসিকতায় সুলগ্না আন্তরিক হাসি ছড়ায়।‘বুঙ্কাই কি খাবে?’ রোহিত জানতে চায়।
‘ওকে স্যাণ্ডুইচ খাইয়ে নিয়েছি।বাড়ীতে যেয়ে একটা ক্রীম চকলেট খেয়ে নেবে’। সুলগ্না জানায়।আমার কৌতুহল-‘কাকিমাও ঐসব খাবেন নাকি?’ ‘মা তো সোনারপুরে ।সেজদার বাড়ীতে’।রোহিত জানায়।সুলগ্না আরও বিশদ হয়-‘ওঃ ওনার খাওয়া দাওয়ার যা ফ্যাচাং।মাছের ঝোলের চেয়ে আর কোন ভালখাবার নেই।শ্বশুরমশায় এখানে, উনি সোনারপুরে।সেজন্য থেকে যেতে বলছি।তোমার নাম্বারটা বের করি-মধুমিতাকে জানিয়ে দিই।নতুবা শুধু শুধু চিন্তা করবে’।ওদের আন্তরিকতার অভাব ছিলনা।তবুও স্কচ ও বজঅন এর চিকেন বিনফক্স এর লোভ ছেড়ে অশোকনগরেই ফিরে যাই সেদিন।

দিনকয়েক পরে ফোনে রোহিতের অফিসে কাকাবাবুর খবরাখবর জানতে চাইলে রোহিত প্রায় ভেঙ্গে পড়া গলায় বলে—‘কিছুই বুঝতে পারছি নারে!বাই দিজ টাইম চার লাখ সাতান্ন হাজার টাকার বিল মেটালাম।গতকাল লাস্ট প্রিন্ট আউটে জানিয়েছে যে বাবার ব্রেনে একটা প্রিক করতে হবে।৫জন ডাক্তারের একটা লিস্ট দিয়েছে,আমাদের পছন্দ মত তাদের মধ্যে একজনকে দিয়ে করাতে পারি।তুই পারলে বিকেলে একবার নার্সিং হোমে আয়’।
আমি নার্সিং হোমে পৌঁছে দেখি রোহিত সুলগ্না দু’জনেই সুবেশা রিসেপশনিস্ট মহিলার কাছে দাঁড়িয়ে।আমাকে দেখেই রোহিত বলে ওঠে-‘কী ঝামেলা বলতো’?
‘কি হয়েছে’?জানতে চাই।‘আরে বাবার পেনশনটা ডিউ হয়ে গেছে।গত দুমাসে তোলা হয়নি।তিনমাস পরপর না তুললে ব্যাঙ্কে আবার গেজেটেড অফিসারকে দিয়ে লিভিং সার্টিফিকেট দিতে হবে।তাই সাইন করানোর জন্য বাবার কাছে চেকবুকটা পাঠাতে হবে।কিন্তু আমার পাসওয়ার্ড নাকি মিলছে না,তাই উনি চেকবই বাবার কাছে পাঠাতে পারছেন না’।
‘কেন মিলছে না কেন?’ আমি মহিলার কাছে জানতে চাই।মহিলাটি ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলেন-‘দেখুন কম্পিউটর তো ভুল করবে না।উনি যদি ভুল পাসওয়ার্ড দেন তাহলে কম্পিউটর সার্চ করবে কিভাবে?’
‘ভুল মানে?’রোহিত খানিক উত্তেজিত হয়ে মানিব্যাগ থেকে ছোট একটা কাগজের টুকরো বের করে মহিলা কে দেখায়।‘এই দেখুন এল৩০৫ডিবি’।মহিলার ঠোঁটের হাসি নষ্ট হয়না-‘কাগজের লেখাটা তো দেখছি কিন্তু কম্পিউটর যে রিজেক্ট করছে’।
আমি মিষ্টি গলায় বলি- ‘ম্যাডাম দেখুন না কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে কিনা?’
মহিলা ভ্রু নাচিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইন্টারকমে কার সাথে জানি কথা বললেন।একটু পরেই ছিপছিপে ধরণের এক তরুন এসে জিজ্ঞেস করলেন-‘কী প্রবলেম?’ মহিলা বলেন-‘আমার কোন প্রবলেম না।উনি যে পাসওয়ার্ডটা দিচ্ছেন তা মেসিন রিজেক্ট করছে’।ছিপছিপে তরুন মহিলাকে সরিয়ে তার চেয়ারে বসলেন।মিনিট দশেক কীবোর্ড টেপাটেপি করে মহিলাকে মৃদু স্বরে ধমকালেন।‘পেশেন্টতো অন্য ওয়ার্ডে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। পাসওয়ার্ড মিলবে কেন?’
তরুনটি চলে যাওয়ার পরে মহিলার ঠোঁটের হাসি সরিয়ে বললেন-‘পেশেন্ট সার্জারীতে ট্রান্সফার হয়ে গেছে বলবেন তো আগে।শুধু শুধু ঝামেলা’।রোহিত গলা চড়িয়ে বলে ওঠে- ‘ট্ট্রান্সফার যে হয়েছে সেটা আমরা জানব কি করে?’আমাদের ঠিক পেছনেই স্বাস্থ্যবান নীল-সাদা ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটির লোক কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।তিনি রোহিতের কাঁধে আলতো হাত রেখে গম্ভীর গলায় বললেন-‘আপনাদের লাস্ট প্রিন্ট আউটেই তো জানানো হয়েছে যে পেশেন্টের সার্জারি দরকার।ডক্টরদের লিস্টও দেওয়া হয়েছে।তাতেই তো আপনাদের বোঝা উচিৎ ছিল।এটুকু যদি কো-অপারেট না করেন তবেতো ডিসিপ্লিন রাখা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়’।
আমি আর রোহিত দুজনেই হতবাক।সমস্যা ঠিক কে যে কিভাবে তৈরী করল কে জানে?রিসেপশনের মহিলাটি ঝুরো চুল বাঁ হাতে সরিয়ে রোহিতের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘দেখুন আমাদের টোটাল ব্যাপারটাই কম্পুটারাইজড।আর আপনারা জানেন যে পাসওয়ার্ড না হলে পেশেন্টের ব্যাপারে কাউকে কোন যোগাযোগ করতে দিই না।আপনি নতুন পাসওয়ার্ডটা দিন।তারপর আপনার প্রয়োজনটা বলুন,আমি রেসপেকটিভ ডিপার্টমেন্টে পাঠাব।ব্যাস, ইয়োর রিকোয়েস্ট বিল বি কমপ্লায়েড একোর্ডিংলি।দিন পাশওয়ার্ডটা দিন’।
রোহিত পিছনে তাকিয়ে দেখে সিকিউরিটির ভদ্রলোক চলে গেছেন।বোধহয় সাহস ফিরে পেয়ে একটু জোরেই বলে- ‘নতুন পাশওয়ার্ড আমাকে দিলেন কখন যে আপনাকে জানাব?’
‘আপনি পাশওয়ার্ড পাননি?ওয়েট আ মিনিট’।কী বোর্ডে কয়েকটা বোতাম টিপে মহিলা মনিটরে চোখ রাখেন।‘এইতো গতকাল পেশেন্ট সার্জারীতে ট্রান্সফার হয়েছে এট ফোরটিন থার্টিটু,ফোরটিন থার্টিথ্রিতে নিউ পাশওয়ার্ড মিস্টার এম কে সানিয়াল কে ই-মেইলে জানানো হয়েছে’।
‘কে এম কে সানিয়াল? আমার বাবা ভর্তি আমি তার ছেলে আর আপনি কে এক সানিয়ালকে পাঠিয়ে দিলেন?’ চেচিয়ে ওঠে রোহিত।
সুলগ্না এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল।‘বিজুদার নামই তো এম কে সানিয়াল।মাধব কিঙ্কর স্যান্যাল।আমার দাদু নাম রেখেছিলেন।উনি তো একটু বৈষ্ণব ধরণের ছিলেন’।
‘তা থাকুন, তুমি এখন তোমার বিজুদাকে মোবাইলে ধর।রোহিত কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।সুলগ্না মোবাইলের নম্বর টিপতে টিপতে ঘাড় বেঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকায়।খবর পেয়ে সুলগ্নার মাসতুতো দাদা বিজুদা মেইল চেক করে পঁইয়তাল্লিশ মিনিট পরে মোবাইল এ সুলগ্নাকে রিং ব্যাক করেন।
রোহিত রিসেপশনে পাসওয়ার্ড দিতেই মহিলা প্রয়োজন জানতে চান।চেকবুকের কথা বলতেই মহিলার ভুরু কপালে ওঠে।‘মাই গড! সে তো ডিসইনফেক্ট করতে হবে।দাঁড়ান, আমি খবর নিয়ে নিই।কী সব কেসরে বাবা!’ আবার কিছু খুটখাট,ইন্টারকমে ফিশফাশ সেরে নিয়ে রোহিতের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘দেখুন আমাদের এখানে আগের কোন এরকম প্রিসিডেন্স নেই।রোগীর কাছে চেক পাঠানো আমাদের কাছে একেবারেই নতুন ইভেন্ট।চেকবই কিভাবে ডিসইনফেক্ট করা সম্ভব কেউই বলতে পারছেন না।সুপারিন্টেণ্ডেন্ট কাল মর্নিং এ এক্সপার্ট কমিটির কাছে পেশ করবেন।আমরা ইনফেকশনের কোন রিস্ক নিতে পারব না।বাই দ্য বাই,আপনাদের একটা ভাল খবর দিচ্ছি’।আমি আগ্রহে কান পাতি-কাকাবাবু সুস্থ হয়ে উঠছেন বুঝি!
মহিলা জানান-‘ডাঃ জ্যোতিকিরণ লণ্ডন থেকে ১০দিনের জন্য এসেছেন।আগামীকাল ইভনিং ফ্লাইটে কলকাতায় আসছেন।আপনাদের পেশেন্টের সার্জারী ওনাকে দিয়েও করাতে পারেন।কাল দুফুরে মধ্যে বুক করবেন। পরশু লেট আফটারনুনে আইজল রওনা হয়ে যাবেন।ইউ ক্যাান এভেইল দিজ অপরচুনিটি’।
সুলগ্না রোহিতকে পরামর্শ দেয়-‘ফাইন্যাল ডিসিশন নেওয়ার আগে তুমি তোমার দাদাদের ও বোনের সাথে কথা বলে নাও’।
‘ডিসিশন কি আমি নিচ্ছি? ডিসিশন নিচ্ছে নার্সিং হোম’।বিরক্ত হয় রোহিত।‘তাহলেও ডাঃ জ্যোতিকিরনকে দিয়ে করাবে কিনা সে ব্যাপারে কথা বলে নেওয়া ভাল।তাইনা রণজিৎদা?’ সুলগ্না আমার সমর্থন চায়।
সুলগ্না মোবাইলে সোনারপুর,বারাসাত,সোদপুর,বেহালা যোগাযোগ করতে থাকে।মিটিং পয়েন্ট এই নার্সিং হোম কাল সকাল দশটায়।

আমি পরের দিন অফিসে না গিয়ে দশটার মধ্যে নার্সিং হোমে পৌছে দেখি রোহিতের দাদা-বৌদিরা,কাকিমা,ছোট বোন ঊষসী সবাই হাজির।কাছাকাছি বসে আছে সবাই কিন্তু কেউ কথা বলছে না।আমাকে দেখে রোহিত কঁকিয়ে ওঠে প্রায়।‘রণজিৎরে আজকেও পাসওয়ার্ড বিভ্রাট।বাবাকে কোন ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করেছে কে জানে? এদিকে সুলগ্নার বিজুদা আজ সকালেই শুটিং স্পট দেখতে ব্যাঙ্কক চলে গেছেন।মোবাইলে কেবল নো রেসপন্স হচ্ছে।আমি কিছু ভাবতে পারছি না।গত সতেরো দিন ধরে কী যে চলছে,তুই দেখ যদি কিছু করতে পারিস’।
আমি হাসি হাসি মুখ করে রিসেপশনে যাই।‘ম্যাডাম কেমন আছেন?রোজ রোজ এত ডিফারেন্ট কুয়ারিজ সামলান কি ভাবে?’ ঠোঁটের হাসিটা ম্যাডামের চওড়া হয় এবং কাঁধ অল্প ঝাঁকিয়ে অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করেন।এই সুযোগে জিজ্ঞাসা করি এস টি টু ওয়ান সিক্স ইউ বি অন্য ওয়ার্ডে ট্রান্সফার হয়েছেন নাকি?’ কী-বোর্ডে খুটখাট করে মুখের হাসি আরও ছড়িয়ে জবাব দেন-‘একটু কমন সেন্স খাটালে কত সমস্যা এড়ানো যায়।আপনি ঠিক ধরেছেন, আপনার পেশেন্ট তো সার্জারী ওয়ার্ডে নেই’।মনিটর এর তাকিয়ে বলতে থাকেন-‘হি হ্যাজ এক্সপায়ার্ড দিজ মর্নিং এট থ্রি ও সিক্স এণ্ড লাইং পিসফু……
‘উনি মারা গেছেন!’ আমার গলা বুজে আসে।
মহিলা কিরকম শশব্যাস্ত হয়ে পরেন।‘সরি সরি।প্লিজ প্লিজ।আমি পাসওয়ার্ড ছাড়াই আপনাকে কিছু ইনফরমেশন দিয়ে ফেলেছি। প্লিজ কাউকে কিছু বলবেন না।আমি অফিসিয়ালি আপনাকে কিছু বলিনি।তাই না?’ মহিলা প্রায় তোতলাতে থাকেন।‘দয়া করে পাসওয়ার্ড নিয়ে আসুন।আমি ডিটেইলস প্রিন্ট আউট দিয়ে দেব।প্লি প্লিজ’।
আমি ধীরে ধীরে রোহিতের দাদা-বৌদি,কাকিমা,ছোটবোন দের কাছে যাই।ওরা আমাকে ঘিরে জড়ো হয়।আমি সকলের দিকে দ্রুত একবার দেখে নিই।তারপর মাথা নীচু করে জানাই-‘ কাকাবাবু আর নেই। সুলগ্না যে ভাবেই হোক তোমার বিজুদাকে কনেক্ট করো নইলে ডেডবডি বের করতে পারব না’।কাকিমার দিকে তাকিয়ে মনে হল বুঝি এখনই পড়ে যাবেন।দু’হাতে ধরে জনার্দন মন্দিরের বেঞ্চে বসাই।কাকিমা মুর্তির দিকে অপলক চেয়ে থাকেন।রোহিত এসে কাকিমার পাশে বসে।কাকিমার বাঁধ ভাঙ্গে।হঠাৎ ডুকরে ওঠেন-‘রোতুরে,আমাকে তোদের বাবার কাছে নিয়ে চল’। রোহিত অসহায়,ফোঁফাতে থাকে-‘মা মাগো বাবার কাছে যাওয়ার পাসওয়ার্ড আমার নেই মা।পাসওয়ার্ড নেই’।রোহিতের মাথা কাকিমার কাঁধে ঝুঁকে পড়ে।বুঙ্কাই ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকে।বিজুদা এখনও নো রেসপন্স।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।