গল্পকথায় প্রদীপ্ত দে
কু চি গা থা
(১)
“তেমন করে দেখলে পরে এই জগতে সবাই ভালো /
নিজের মনের মাঝে রে বাস অন্যজনের সাদা- কালোর.. ”
চলতে চলতে নিজের মনে গাইতে থাকে গা । একরত্তি মেয়েটার এই এক দোষ । গানটা শুনেই রেগে ফোঁসফোঁস করে এগিয়ে আসে গা এর মা
– তোর আক্কেল কবে হবে শুনি? তোকে বলি না সবসময় গান গাইবি না ?!! আমাদের মধ্যে এসবের চল নেই । এরপর তোকে বাসায় আটকে রেখে আসব । আর বেশি বেয়াদপি করলে তোকে বাইরে কোথাও ছেড়ে আসব বলে দিলাম ।
গা এর মায়ের ধমক খেয়ে চুপ করে যায় গা । গা এর বাবা এগিয়ে আসে
– ওকে এইভাবে বকলে আমার বড় খারাপ লাগে গো । এইভাবে বকো না । ও নিজেই বুঝতে শিখবে ।
খেঁকিয়ে ওঠে গা এর মা
– আর কবে শিখবে!! সেদিন কী করেছে জানো? গান গাইতে গাইতে মেছোদের সংকেত চিহ্ন ধরে ধরে ওদের বস্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল । শেষ মুহূর্তে ওকে আটকেছি । নাহলে সেদিন ওরা ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে যেত ।
–
আঁতকে ওঠে গা এর বাবা
– সেকী মা! আর এরকম করিস না মা ।
কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দেয় গা
– কিছুই ইচ্ছে করে করি না বাবা । হয়ে যায় । নিজেদের সংকেত চিহ্ন আর ওদের সংকেত চিহ্ন আলাদা করতে পারি না । আমি বুঝতেও পারি না যে আমাদের মধ্যে এত বিভেদ কেন!
– বিভেদ সব জায়গায় রে মা । ওরা হচ্ছে আমিষভোগী আর আমরা হলাম নিরামিষাশী । সেজন্যই তো আমরা ঘেসো আর ওরা মেছো ।
– বাবা, মানুষের মধ্যেও এত বিভেদ থাকে ?
প্রশ্ন শুনে রে রে করে তেড়ে আসে গা এর মা
– আবার মানুষের সাথে তুলনা?!! ওদের এসব সংকেত দেওয়ার ক্ষমতাই নেই । আমাদের সংকেতের ওরা নাম রেখেছে ফেরোমন । বড় বড় লোকেরা এসব নিয়ে দিনরাত মাথা ঘামাচ্ছে । ওরে, পিঁপড়ে হচ্ছে এ গ্রহের সবথেকে প্রাচীন এবং উন্নত জীব । সেই তুলনায় মানুষেরা অনেক অর্বাচীন । তুলনাই চলে না । অন্য প্রাণীদের ধ্বংস করে করে মানুষ সর্বশক্তিমান হয়ে উঠেছে । তবুও শুনে রাখ, এখনো এই গ্রহে মোট মানুষের ওজন আর মোট পিঁপড়ের ওজন সমানে সমানে টক্কর দেয় ।
– হুম, সেটা তো শুনেছি ।
– ঠিক আছে । এখন কাজে যা । আর যাবার সময় এবং ফেরার সময় নিজের বস্তির পিঁপড়ের সাথে ফিরবি । আমাকে অন্য কাজে যেতে হবে ।
( ২ )
মেছো দলের বাসায় ফেরার পথের লম্বা লাইন । সারি দিয়ে হাঁটা সবারই মুখে- মাথায় খাবার । লাইনে শুধু একজনেরই মাথায় একটা অন্য জিনিস । একটা ছোট্ট পিঁপড়ে ।
বাসায় ফিরে মাথা থেকে হালকা করে পিঁপড়েটাকে নামিয়ে রাখে থা । বাসার একপাশে ঝিমোচ্ছিল সু । মায়ের আনা নিস্তেজ পিঁপড়েটাকে দেখে গা শিউরে ওঠে তার । উদ্বিগ্ন শরীরে জিজ্ঞেস করে
– এ কী মা! এ কার মৃতদেহ নিয়ে এসেছ? এ তো মনে হচ্ছে ঘেসো পিঁপড়ে! তাও একদমই ছোট্ট । একে নিয়ে এবার দুটো দলে কত খুনোখুনি হবে তুমি জানো না?
কথাটা বলতে বলতেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় বাচ্চা মেয়ে পিঁপড়েটি । থা এর মুখে স্মিত রহস্যের হাসি । সু এর ঘোলাটে দুটো চোখ যেন সাবুদানার মতো বড় হয়ে গেছে । অবাক হয়ে বলে
– মা, এ তুমি কী করেছ?!! এ তো বেঁচে আছে । বেঁচে থাকা ছোট্ট ঘেসো মেয়েটাকে বাসায় আনলে কীভাবে?
– কী করবো বল্ তো । আমরা বেরিয়েছি রাণীর সাথে টহল দিতে । তার মধ্যে হঠাৎ এক দঙ্গল আলাদা হয়ে গেলাম একটা আরশোলার দেহ পেয়ে । আরশোলার দেহের টুকরো নিয়ে ফিরছি তখনই দেখি এক কান্ড! এই পুচকিটা গুনগুন করতে করতে আমাদের লাইনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে । গন্ধ শুকতেই বুঝে গেলাম যে এ ঘেসো দলের মেয়ে । চট করে যেটুকু ঘেসোদের ভাষা জানতাম সেই বিদ্যেতে ওকে বললাম মটকা মেরে শুয়ে থাকতে । আর আমি মাথায় করে নিয়ে চলে এলাম । নেহাত সবার ভাগেই আমার থেকে বেশী পড়েছিল তাই এযাত্রায় মেয়েটা বেঁচে গেল । অন্য কেউ ভাগ চাইলে যে কী হতো !
– এবারে তুমি কী খাবে?
– আমার আর খিদে নেই । তুই বরঞ্চ কিছু খেয়ে আয় বাইরে থেকে ।
মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে সু উত্তর দেয়
– মোটেই না। পুরনো যা খাবার আছে তাই দিয়েই দিব্বি চলবে । তুমি যে একটা প্রান বাঁচিয়েছ মা, তাতেই আমার পেট ও মন দুটোই ভর্তি হয়ে গেল ।
(৩)
দুদিন কেটে গেল নির্বিঘ্নে । গা এর শরীর থেকে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসে সুরেলা সঙ্গীত । থা আর সু মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে, আত্মস্থ করে গানের কথা । শুনতে শুনতে বিবশ হয়ে তারাও গাইতে থাকে দু-তিন কলি । দিনের বেলায় দুজনে পালা করে পাহারা দেয় গা কে । রাতে সব পিঁপড়ে যখন দু-দন্ড জিরিয়ে নেয় তখনও সু জেগে থাকে । তৃতীয় দিন রাতে বাসার বাইরে পায়চারিরত সু হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। একটা উগ্র গন্ধ ভেসে আসছে । সু ভাবতে থাকে, খুব ভুল না করলে এই গন্ধ ওর চেনা। ওদের দলের সবথেকে নিষ্ঠুর এবং কুটিল পিঁপড়ে কু এর গায়ের গন্ধ। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও আছে। খুব তাড়াতাড়ি বাসার মুখে এসে বিশ্রাম নেওয়ার ভান করে সু। কিছুক্ষণ পরেই আশঙ্কা সত্যি করে উদয় হলো কু । মুখে চাপা কৌতূহল। সু এর বাসার ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে বলল কু
– কী করিস সু ? রাতে ঘুমোস না কেন ?
– হাসালে কু চাচা ! পিঁপড়েরা আবার মানুষের মতো শরীর উলটিয়ে ঘুমানো শিখলো কবে থেকে ?
– শরীর উলটিয়ে না হোক, টুকরো বিশ্রাম তো নিবি। তাও তো তোকে নিতে দেখি না আজকাল ।
– নিই তো । রোজ নিই । তোমার মতো বড় সেনাপতির কি আর আমাদের দিকে নজর দেওয়ার সময় আছে!
– হুম… সব দিকেই নজর রাখতে হয় রে! পিঁপড়ের সেনাপতি হয়েও সেনাপতির নজর রাখতে হয় ।
কথাটা বলতে বলতে দুটো পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অল্প এগিয়ে হঠাৎ থমকাল কু। তারপর ঘাড় ঘোরালো ।
বাসার ভেতর থেকে গা গাইতে শুরু করেছে। হাল্কা আওয়াজ ভেসে আসছে । সু বুঝতে পারলো, সেটা শুনেই চলার গতি রোধ করেছে কু । গাএর আওয়াজ চাপা দিতে চট করে সু গাইতে শুরু করলো
– তেমন করে দেখলে পরে এই জগতে সবাই ভালো | নিজের মনের মাঝে যে বাস অন্য জনের সাদা- কালোর…. “
গানটা শুনে একটা ফিচেল হাসি দেয় কু । তারপর চোখ উঁচিয়ে বলে
তুই আবার কবে এসব গাইতে শুরু করেছিস রে ?
কু এর কথা শুনে থামলেই বিপদ! গা এর গান চাপা দেওয়ার জন্য সু গেয়েই যায় । কু আবার পেছন ফিরে যেতে যেতে বলে
– ভালো, ভালো । গান গাওয়া ভালো । যত পারিস গেয়ে নে । তবে রাতে অন্যদের কথা ভেবে আস্তে গাইবি।
(৪)
পরের দিন ছোট্ট গুহাটার ভেতরে একটা পাথরের ওপরে এসে বসেছে কু । আলকাতরা রঙের পেটানো শরীর তার । মাথার একপাশটা যুদ্ধে তোবরানো। দুখানা পা হাল্কা টেনে টেনে চলতে হয়। কিন্তু তাকে ল্যাংড়া কেউ বলতে সাহস পায় না । কার ঘাড়ে একাধিক মাথা আছে ! সবাই অবনত মস্তকে শুধু কথা শুনছে । এর বেশি কারোর অধিকার নেই। রাগের চোটে মাথা বেদম ফুলিয়ে হুংকার ছাড়ে কু
– সব্বাই শুনে নাও। ওপাশের ঘেসোদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই । ওরা সব দিক থেকেই আমাদের থেকে দুর্বল। আমিষ খেতে খেতে আমাদের গায়ে যা কষ এসেছে, ওদের গায়ে তার সিকিভাগও নেই। তাই বর্ষা আসার অনেক আগেই আমরা ওদেরকে আক্রমণ করবো । ওদেরকে পরাজিত করে কিছু বন্দী বানাবো, কিছু মেরে খেয়ে নেবো সবাই মিলে। আগামী বছর অবধি রসদের আর চিন্তা থাকবে না।
কু এর ভাষণ চলাকালীন দলের রাণী চি পেছনে এসে দাঁড়ালো বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে। শরীরের চলনে গভীর আত্মবিশ্বাসী ভাব । সবাই চুপ করেই ছিল। পেছনের সারি থেকে সু ঘাড় উঁচিয়ে বলে উঠলো
– কু চাচা, যুদ্ধতে তো দুটো দলেরই প্রানহানি হবে। তার থেকে অন্য ব্যবস্থা করলে ভালো হতো না ?
কথাটা শুনে চি এর তীর্যক দৃষ্টি বিদ্ধ করলো সু কে। কু চোখ উচিয়ে বললো
– বটে ! কালকের ছোকরার বুলি ভালোই ফুটেছে ! কেমনতর ব্যবস্থা করতে চাইছো বলো ?
সু আরো একটু ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে বললো
– ঘেসোদের বস্তিতে শুনেছি অপর্যাপ্ত খাবার । খাবারগুলো খেতেও খারাপ না । ওদের খাওয়া আর নেওয়ার পরেও অনেক খাবার থাকে। ওদের বাড়ির মানুষদের অনেক পয়সা শুনেছি। আমিষ খাবার ফুরিয়ে গেলে আমরা নয় ঘুরপথে গিয়ে খাবার নিয়ে চলে আসবো। তাতে আমরা সবাই বেঁচে থাকবো।
এবারে চি এর গলায় ভৎসনা শোনা গেল
-মানুষের এঁটো খাবার খেয়ে খেয়ে , মানুষের সাথে থেকে থেকে মানুষের আলসেমি রোগ তো তোকেও ধরে নিল রে সু । মানুষের মতো করে ভাবতে শিখছিস দেখছি ! মানুষ এখন দুটো করেকম্মে খাচ্ছে বলে ভাবিসনি যে আমাদের টপকে গেছে। জীবজগতের শ্রেষ্ঠ জীব পিঁপড়ে ছিল, আছে, থাকবে । আমরা পৃথিবীতে যুগের পর যুগ থেকে গেছি এই লড়াই করে। জিজ্ঞেস করিস তোর দাদুকে । ডাইনোসর থেকে শুরু করে বাকি সব প্রানীরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে । আমরা লড়াই করে রয়ে গেছি। মানুষের মতো আলসে জীব আর আছে ?! তারা ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমোয় । অর্ধেক মানুষ তো তেমন কাজই করে না । তুই আমাদের মধ্যে একটা পিঁপড়ে দেখা তো যে কাজ করে না । কেউ খাবার খোঁজে, কেউ খাবার আনে তো কেউ বস্তি পরিষ্কার করে,কেউ বাচ্চা পালন করে ।
চি এর ভাষণের পর কু ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুরে বলল
– খোলতাই করে বলো তো ছোকরা , বলতে কী চাও ? তোমার ভাবভঙ্গি গত কয়েকদিন বেশ সুবিধের ঠেকছে না মোটেই।
চি এরপর যোগ করলো
– সু,একথা কানে আসছে, তুমি নাকি সারা রাত জেগে থাকছো ? সবার পালায় যেটুকু ঘুম পড়ে সেই ঘুমটুকুও ঘুমাচ্ছো না ? কী এতো চিন্তা তোমার ? বাসায় কী এমন গুপ্তধন রেখেছ যে দু দন্ড চোখ উল্টোতে ভয় করছে ?
– নন্ না তো , কই ঘুমাই তো !
সু আর এগোলো না। বরং একটু পিছিয়েই গেল। কু আর চি এর নজরে পড়ার অর্থ সে জানে ।
কিন্তু,কু তো ছাড়ার পাত্র নন্। সে আরো একটু শান দিয়ে বলল
– ওপরচালাকি কু এর সাথে চলে না। আমি লক্ষ্য করেছি তোমার বাসার ভেতরে একটা অন্য গন্ধ । এবং সেই গন্ধটা বলাই বাহুল্য ঘেসোদের মতো। আর তার সাথে দিবানিশি চলছে একটা মৃদু সুর। আমাদের মধ্যে কেউ গান গাওয়ার মতো বদঅভ্যাস তো রাখে না । সৈন্যরা চলো তো দেখি ব্যাপারটা কী ।
সু এসে প্রথমে অনুরোধ করলো। পরে পায়ে পড়লো। কিন্তু,কু এর মন যেন পাথরচাপা জীবাশ্ম , অনুভূতি আর আবেগের সেখানে কোনো স্থান নেই।
বাসায় ঢুকতেই থা এসে রুখে দাঁড়ালো
– কু, তুই ভুলে গেছিস কার ডেরায় এসেছিস ! আমার স্বামী জো কিন্তু সেনাপতি ছিল একসময়। যে পিঁপড়ে তোদের বাঁচাতে আত্মবলিদান দিয়েছে , তুই তারই ঘরে ঢোকার সাহস পাস কীকরে ?
কু এর সৈন্যরা একপাশে কোণঠাসা করে ধরে রাখলো থা কে । কু থা এর কথায় মুখে একটা বিদ্রুপের হাসি এনে বললো
– ওসব পুরনো কথা কেউ মনে রাখে না। তাছাড়া আমি যা করি সব রাণীর ইচ্ছায় করি । তুই এসব কথা রাণীকে বলিস।
– ওই মুখপুড়ি চি একটা রাণী ! এতো নিষ্ঠুর রানী পিঁপড়ে আমি দেখিনি কোনদিন। অমন রাণী আমি মানি না ।
থা খানিকটা এসব বলে কু এর মনোযোগ কেড়ে নিতে চাইছে। কু কী যেন একটা দেখে একটু গুটিসুটি মেরে এগিয়ে যেতে যেতে বললো
– খবরদার থা ! রাণীর বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে জানিস তো ? দলদ্রোহিতার অভিযোগে তোকে গিয়ে কবরস্থানে ফেলে আসা হবে ।
– ভালোই হবে ! জ্বালা জুড়োবে !
থা এর চেষ্টা বিফলে গেল। কু টেনে-হিঁচড়ে বার করলো বলের মতো গুটিয়ে থাকা গা কে । তারপর দশজন সৈন্য মাথার ওপরে তুলে নিয়ে চললো রাণীর কাছে । যেতে যেতে কু নজর ঘুরিয়ে বললো
– এখানে দশজন সৈন্য থাকো । থা কে পাহারা দেবে যতক্ষণ না আদেশ তুলি ।
থা এগোতে পারলো না । তাকে ঘিরে ধরলো সৈন্যরা। শুধু ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলো একরত্তি মেয়ে পিঁপড়েটাকে ওরা নিয়ে চলে গেল।
তারপর রাণী চি এর সামনে গা কে রেখে সরে এলো সৈন্যরা। রাণী আশ্চর্য হয়ে বললো
– কে এই মেয়ে ?
কু লেংড়ে লেংড়ে আবার তার পছন্দের ঢিবিটার ওপরে উঠে সামনের পা দিয়ে মাথায় দুবার হাত বোলালো । যখনই নিজেকে গর্বিত সেনানায়ক মনে করে তখনই সে এটা করে। তারপর বললো
– বলেছিলাম না রাণী , একটা সন্দেহ হচ্ছে। মিললো তো ? এ ঘেসুদের থেকে এখানে কোনোভাবে চলে এসেছে। তবে, এর গায়ে কিন্তু রাণী ঘরানার গন্ধ আছে। ঘেসোদের রানী মি এর মেয়ে হলেও আশ্চর্য হবো না ।
– বটে !
চি এর মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি । এতদিনে ঘেসোদের জব্দ করার জন্য মোক্ষম কিছু তার হাতে এসেছে। চেচিয়ে সামনের দুটো শুঁড় তুলে বললো
– নিয়ে যাও একে আর বন্দী করো । খাবার,জল কিচ্ছুটি দেবে না। আমি নিজে একে খেয়ে তৃপ্ত হবো । নিয়ে যাও ।
সৈন্যরা গা কে তুলে নিয়ে গিয়ে রাখলো রানীর অন্তঃপুরে। গা এর বেদম কান্না পেল নিজের পরিণতির কথা ভেবে। বাবা-মা-ভাই-বোন কারোর সাথে আর দেখা হবে না সেকথা ভেবে ।
(৫)
প্রথম দিন খুব মন খারাপে কাটালো গা । দ্বিতীয় দিন থেকে আবার সেই সঙ্গীতের নাছোড় ভুত মাথায় চেপে বসলো। আশ্চর্য ! তার নিজেরও আশ্চর্য লাগলো বেশ ! তার মৃত্যু আসন্ন। শত্রুর শিবিরে তাকে খাবে বলে শুড় মচলাচ্ছে রানী চি। তবু এর মধ্যেই তার মাথায় আসছে নতুন সুর । একটা বিষাদকরুন সুর। অশ্রুসিক্ত একটি অপূর্ব তরঙ্গের কম্পন উঠছে তার পশ্চাদদিক থেকে। সে ভাবতে থাকে, এতো অনির্বচনীয় সুরের মূর্ছনা তার কাছে ধরা দিল কীকরে !!
আত্মমগ্ন হয়ে সে শুধু সেই সুরের সাথে ভেসে যেতে থাকে । কাছাকাছি রাতের কর্মীদের নিজস্ব কর্মসূচি বলছিল চি। বারবার তার কাজে ব্যঘাত আনছিল সেই সুর। সবাইকে শীঘ্র বিদায় দিয়ে সে সমস্ত শরীর পেতে অনুভব করলো সেই সুর। এমন সুর কীকরে তোলে এই একরত্তি মেয়ে ! সাহসেরও বলিহারী বলতে হবে ! চি এর বন্দি হয়েও সুর ভাজছে ! মেয়েটার মাথায় কীআছে !
বুদ্ধির বৃহস্পতি !!
অন্যদিকে সু সবার সাথে খাবার নিয়ে সবে ফিরে একটু জিরোচ্ছিল । বাসায় গেলেই সৈন্যদের ঘিরে থাকা মাকে দেখলে নিজেকে অপরাধী লাগে সু এর। তাই বাসার অনেক আগেই একা বসেছিল । কানে এসে পৌছালো গা এর গান। মাথায় দুশ্চিন্তা হলো মেয়েটার জন্য। সু শুনেছে যে মেয়েটাকে চি খাবে বলে অভুক্ত করে রেখেছে । গা এর সুরের ভেসে আসার রাস্তা ধরে ধরে একটা মাটির দেওয়ালের কাছে এসে দাঁড়ালো সু । সুরের আওয়াজ আসছে ঠিক দেওয়ালের ওই পার থেকে। দুইদিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার দেখে নিল সু। কেউ নেই দুপাশে । এবারে আস্তে আস্তে করে চারটে পা দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে লাগলো সে । সাথে একজনের খাবার আছে তার। যদি পৌছানো যায় তাহলে মেয়েটার দুমুঠো জুটবে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেওয়ালের ওদিকে গিয়ে মুখ বাড়ালো সু। দুদিকেই পাহারারত সৈন্যরা আছে। তবে ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত। গেরস্থ বাড়িতে যে নতুন ওষুধ এনেছে তাতে জনা বিশেক পিঁপড়ে আজ ফিরতে পারেনি। সবারই সলিলসমাধি ঘটেছে । সেসব নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। সুযোগ বুঝে গা কে ইশারায় ডাকলো সু । তারপর গর্তের মধ্যেই খাবারটা রেখে মাটিচাপা দিয়ে দিল । নাহলে গন্ধ পেয়ে হাগড়ের দল সব সাবাড় করে সবাইকে জানিয়ে দেবে গর্তের কথা। সু বিদায় নিয়ে ফেরার সময় গর্তের কাছে এল গা। তারপর মাথা নামিয়ে,শুড় এলিয়ে বলল
– আমি আর আমার বাবা-মা কে দেখতে পাবো না , না সু চাচা ?
কচি মেয়েটাকে যুতসই জবাব দিতে পারেনা সু । মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে
– তুমি খেয়ে নাও দিদিভাই। আমি আবার পারলে মাঝরাতে আসবো।
কিছুক্ষণ পরে নিজের বাসায় ঢুকে সবার অলক্ষ্যে থা কে বলে সু
– মা, গা কে একটা গোপন সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খাবার পৌঁছে দিয়েছি।
থা যারপরনাই উচ্ছ্বসিত
– তাই নাকি ! যাক ,তোর বাবার মুখরক্ষা হলো । আজ তোর বাবা থাকলে ওইটুকু বাচ্চা মেয়েটার ক্ষতি হতে দিতো না। বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতো যে পিঁপড়েটা !
সমস্ত গা বেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো থা। সু দুঃখ করে বললো
– বেচারির বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে ভীষণ ! চি এর ঘরের পাশ দিয়ে গেলেই ওর সেই গান শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আমি বলেছি আবার মাঝরাতে যাবো।
– দেখ না বাবু ,যদি ওকে ওখান থেকে বের করা যায় ।
মহা ফাঁপরে পড়লো সু । এ কী বলছে মা খেয়াল আছে ! চি এর ঘর থেকে বের করে দেওয়া মানেই আমি বেইমান। সবাই মিলে খুঁটে খুঁটে মেরে ফেলবে । নাহলে অন্তত দলদ্রোহিতার অভিযোগে মরণরস লাগিয়ে তাকে ফেলে দিয়ে আসবে মরদেহ ফেলার জায়গায়। আর দলেই জায়গা পাবে না।
কী রে সু ? কী এতো ভাবছিস ?!
সম্বিত ফেরায় থা । মুখে কিছু বলে না সু । মায়ের ওপরে সে এখনো কিছু বলে উঠতে পারে না। দু-মুঠো খেয়ে উঠে পড়ে। প্রচুর উত্তেজনা জমে পেট ভরে গেছে তার। এমন দোটানায় আগে কখনো পড়তে হয়নি যে !
– মেয়েটার গানের কথাগুলো এখনো কানে ভাসছে ।
কথাটা বলে থা গুনগুনিয়ে ওঠে,
কারোর মুখে হাসি আনো , কারোর বিপদে করো /
একটা ছোট্ট প্রান দিয়ে তুমি আপ্রাণ হয়ে লড়ো…
(৬)
দুটো পা লেংচে লেংচে তড়বড়িয়ে ঘরে ঢুকলো কু ।
– ডেকেছিলেন মহারাণী ?
– হুম,ডেকেছিলাম তো ! আচ্ছা তুমি বিভিন্ন দলের গুপ্তভাষা কীভাবে জানি রপ্ত করেছিলে না কম বয়সে ? মনে আছে ?
শুড় টা আস্তে করে মাথায় বুলিয়ে নিয়ে লজ্জা আর আত্মগরিমা মিশ্রিত সুরে বললো কু
– হেঁ হেঁ …. কমবয়সে কেন বলছেন মহারাণী ? এতো আমি এখনো চর্চা করি । আমার প্রিয় বিষয় ।
– আচ্ছা !! বাবা ! বিদ্বান ব্যক্তি তুমি ! আচ্ছা ওই পিদ্দি মেয়েখানা কী গাইছে বলো তো সুর করে ? কথাগুলো ধরতে পারো ?
– বিকেল থেকেই কানে আসছে মহারাণী । এখনকার বাচ্চাদের কী আর বলবেন ! মরবার আগেও দেখি পেছনে সুর আসে !
– কী গাইছে বলো তো ?
খানিকটা সুর দেওয়ার চেষ্টা করে বললো কু
– ওই তো,
যে আমায় ভালবাসে অথবা যে ঘৃণা করে ,
আমার এই ভালোবাসা সব পিঁপড়েরই তরে ।
তেমন করে দেখলে পরে এই জগতে সবাই ভালো
নিজের মনের মধ্যে যে বাস অন্যজনের সাদা- কালোর …
– এটা আবার কেমন গান হলো ! তুমি মানেটা বুঝতে পেরেছো ?
– আজ্ঞে মহারাণী, প্রথম দু লাইন তো চিনির মতো পরিস্কার ও মিঠে। পরের লাইনগুলো কেমন খেঁজুরগুড়ের মতো কালো আর রহস্যময়। আমিও ভাবছিলাম কী মানে হতে পারে, তার মধ্যেই আপনার তলব পড়লো ।
– ঠিক আছে। ভেবে নিয়ে বলো তো । বুকটা কেমন ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভাবছি বেটিকে কালকেই খেয়ে নেবো ।
– বেটিকে টিপে চুপ করিয়ে দিয়ে আসবো ?
– তোমাকে আমি বলেছি সেটা করতে ?!! যেটুকু বলছি সেটুকু করো । যাও । আমার খাওয়া হয়ে গেলে আজ রাতের জন্যে ওই তাগড়া ছোড়া জো কে পাঠিয়ে দিও ।
কু তবু গেল না। একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো । রাণী চি লাল বাতাসার একটার টুকরোর ওপর আয়েশ করে বসতে গিয়ে আটকে গেল কু কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে
– তোমার স্পর্ধা তো দিনদিন বাড়ছে কু ! তোমাকে যেতে বললাম না ?!!
– মহারাণী, মাফ করবেন। আপনি এইটা তো ভেবে দেখলেন না যে ওই ঘেসো ছুড়িটা না খেয়ে কীকরে গান গাইছে ?
– মানে ? ভণিতা না করে সোজাসুজি বলো ।
– মহারাণী, আমি গুপ্তসূত্রে জানতে পেরেছি যে মেয়েটা অভুক্ত নেই। লুকিয়ে খাবার পাচ্ছে।
– মানে ?! কে খাবার দিচ্ছে ওকে ? কার এতো সাহস ?!!
হঠাৎ গর্জে উঠলো রাণী।
– সু ছেলেটা খুব বাড় বেড়েছে রাণীমা। ওকে খুচিয়ে খুচিয়ে ওর মায়ের সামনে মেরে ফেলুন । এরপর আর কেউ কখনো …
কথা কেড়ে নিল অধৈর্য চি ।
– আবার ফালতু কথা ! বিচারের নিদান দেবার তুমি কে হে ! রাণী আমি। কিন্তু, সু এমন পাগলের কাজ করছে কেন বলো তো ? প্রজাদের শাস্তি তো দেবোই, কিন্তু এমন অপরাধের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটাও তো রাণী হিসেবে জানা প্রয়োজন।
– ব্যাখ্যা কিছুই নেই । সু আগে থেকেই এমন আধপাগল ছিল। এখন আরো অর্ধেক হয়ে গেছে । ওর খালি একই কথা,” পিঁপড়ের আবার জীবন ! মানুষের এক টিপেই শেষ । তাই এত ক্ষুদ্র জীবনের একটাই উদ্দেশ্য, অন্যের সাহায্য করা। পিঁপড়ের পাশে দাঁড়ানো। এইসব হাজুং বাজুং কথা ! এতে ওর মরেও শান্তি । তাই তো ও একাই নাকি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে গা কে ।
– কী জ্বালা ! মেয়েটার নাম গা ?
– হ্যা,তাই তো শুনলাম । আজ রাতে নাকি আবার আসবে ।
– অহ্ …. তাহলে কু আজ রাতে আর ওই জো ছোকরাটাকে পাঠিও না । তুমি চলে এসো ।
কথাটা শুনে কু সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়লো চি এর সামনে। গদগদ হয়ে বলল
– কী করে যে বোঝাবো আপনাকে। আমি আপ্লুত ! আমি বয়স্ক হলেও ফুরিয়ে যাইনি। আমি আপ্রাণ প্রচেষ্টা করবো আপনাকে তৃপ্ত করার । আপনাকে আনন্দের শিখরে পৌঁছে দেবো ।
শুড় নিয়ে তেড়ে এসে একটা তীব্র গলাধাক্কা মারলো চি
– ল্যাংড়া বুড়ো ! আপদ একটা ! তোর স্পর্ধা তো কম নয় । আমি তোকে এমনি আসতে বলছি। সু এর গতিবিধি লক্ষ্য করবো বলে। দেখি ব্যাটা কতো বাড়তে পারে ।
মুখটা পাংশুটে করে বললো কু
– যথাজ্ঞা মহারাণী ! আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। কেন যে দিনদিন নির্বোধ হয়ে যাচ্ছি, কে জানে ! চলি ।