এই বাড়িটার মধ্যে একটা হেব্বি ব্যাপার আছে – বলতে বলতে শিস দিতে দিতে এগোল সুরজিৎ।
গাড়ি থেকে নেমেই নন্দিতার কেমন যেন লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল এই বাড়িটার চারপাশে একটা কেমন যেন ক্ষুধার্ত ব্যাপার আছে। কেন মনে হল তা নন্দিতা জানে না। সুন্দর একটা ফার্ম হাউস। কাঠ আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি। চারপাশে কলা, নারকেল ও আরও বিভিন্ন গাছে গাছে ছাওয়া সবুজে সবুজ। রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে সেই সবুজ কিছু অগোছালো। শহরের মানুষ এমন প্রকৃতির কাছে এলে মন খুশি খুশি হওয়ার কথা। অথচ নন্দিতার মন টিক টিক করছিল।
সুরজিৎ বেশ গটগট করে হেঁটে গেল গেটের দিকে। নিজেই গেট ফেট খুলে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে। সামনেই ছোট্ট একটা কাঠের বারান্দা। সুরজিৎ সপ্রতিভভাবে চাবি দিয়ে দরজা টরজা খুলে ফেলল, সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে ফেলল। তারপর পর্দা সরিয়ে জানলা খুলে ঘরের ভিতর থেকেই ডাকল – কীরে! দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় ভিতরে আয়।
বাইরে তখন খটখটে রোদ। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নন্দিতা।
সুরজিতের ডাকে সে ঘরে ঢুকে এল। ঘরটা কিছুদিন বন্ধ থাকায় একটা হালকা ভ্যাপসা গন্ধ রয়েছে। দরজায় দাঁড়িয়েই নন্দিতা বলল – ধুপের গন্ধ! বন্ধ ঘরে ধুপের গন্ধ কেন?
সুরজিৎ নাক টেনে টেনে গন্ধ শুঁকে বলল – কই না তো? আমি কোন গন্ধ পাচ্ছি না তো। একটা ভ্যাপসা গন্ধ রয়েছে। বোধহয় এজেন্সির লোকজন ন্যাপথলিন ফলিন দিয়ে যায়। সেই গন্ধই পাচ্ছিস।
এই বাড়িটা কোন লোক শখ করে বানিয়েছে। তারপর লিজে দিয়েছে শহরের কোন ট্রাভেল এজেন্সিকে। সুরজিৎ গাড়ি আর বাড়ি দুটোই সেই এজেন্সির কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে। গাড়িটা সে নিজেই চালিয়েছে।
সুরজিৎ আলতো করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর নন্দিতার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল – ঘাম ঘাম মুখে তোকে খুব সেক্সি লাগছে। একটু কাছে আয় না! আর কতক্ষণ উপোষী করে রাখবি।
নন্দিতা বলল – জানলা খুলে দিয়েছিস তো।
সুরজিৎ ওর কাছে এসে বলল – তাতে কী! আশেপাশে তো কিস্যু নেই, কে তোকে দেখবে?
জানলা দিয়ে তুমুল হাওয়া আসছে। পর্দা টরদা ফানুসের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। কাছেই সমুদ্র। সেই সমুদ্রের হাওয়া ডাকাতের মতো হইহই করে সবদিক দিয়ে ঢুকছে। তারা যেন কোন বাধা মানবে না। সবকিছু লুটেপুটে নেবে। নন্দিতাকে পাগলের মতো চুমু খেতে খেতে সুরজিৎ ঘড়ঘড়ে গলায় অস্ফুটে বলল – আর – আর – তাছাড়া ওপেন নেচার মেকস মি অন, আজ রাতেরবেলা খোলা ছাদে যাব, দেখবি ভাল লাগবে।
(দুই)
বিকেলের দিকে বেডরুম থেকে বেরিয়ে বাড়িটার পিছনদিকে গেল নন্দিতা। সুরজিৎ ঘোঁত ঘোঁত করে ঘুমোচ্ছে। বাড়িটার পিছন দিকে বেশ গাছ টাছ আছে। জায়গাটা খুব নির্জন। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যায়। সি বিচটা কাছেই বলে সমুদ্রের শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নন্দিতার ইচ্ছে আছে আজ সন্ধের দিকে সুরজিৎকে বলবে গাড়ি নিয়ে বিচটার দিকে যেতে। অন্ধকারে সমুদ্র দেখতে তার ভারী রহস্যময় লাগে। ফেনা ফেনা জলে পা ডুবিয়ে সে সেই রহস্যময়তাকে একটু অনুভব করবে।
বাড়িটাকে এখন আর তার এমন কিছু খারাপ লাগছে না। ছোট বাগানটায় বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ, একটা জাম গাছ আর একটা কলা গাছ আছে। এই কলাগাছটা একদম বাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সবুজ সবুজ পাতা। কচি কলাপাতার রঙ ভারি ভালো লাগে নন্দিতার। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল কলাগাছটা যেন একটা তার বয়সী মেয়ে, সবুজ রঙের একটা পোষাক পরে রয়েছে। হালকা মরা আলোয় গাঢ় সবুজ রঙের পাতাগুলো যেন মেয়েটার মাথার লম্বা লম্বা চুল। দেখতে দেখতে নন্দিতার মনে হল কেউ যেন তাকে দেখছে। হালকা একটা অস্বস্তি হতে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখল। উপরের দিকে তাকাল। নাহ সুরজিতও সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। নন্দিতা ঘরের দিকে চলল।
ঘরে ফিরে এসে দেখল সুরজিৎ সিগারেট ধরিয়ে টিভি দেখছে। নন্দিতা বলল – চল না একটু সি বিচের দিকে যাই।
সুরজিৎ বলল – ধুসস। এই অন্ধকারে বিচে গিয়ে কী করবি? আয় না বিছানায় আয়। আর একটু গল্প করি। আর তাছাড়া রাতের দিকে ছাদের দিকে যাব, ছাদটা দেখেছিস –
বাইরে বেরলেই সুরজিৎ শুধু বিছানা চেনে। নন্দিতার বিরক্ত লাগে। তাদের সম্পর্কটা এই তিন বছরে খুব দ্রুত এগিয়েছে। নন্দিতার একমাত্র দুর্বলতা সুরজিৎ। তাকে কিছুতেই না বলতে পারে না সে। তার এমন অনেক অন্যায় অনায্য দাবিও সে মেনে নিয়েছে যার কথা তিন বছর আগে সে কল্পনাও করতে পারত না।
সে বলল – আমার ভাল লাগছে না। বেড়াতে বেরিয়ে কী সবসময় এইসব?
সুরজিৎ তার হাত ধরে টেনে বলল – রাগছিস কেন?
(তিন)
সেদিন রাতে আর ছাদে যাওয়া হল না। সারাদিনের জার্নিতে দুজনেই ক্লান্ত ছিল। আসার পথে কিছু বার্গার পার্সেল করে নেওয়া হয়েছিল। রাতে সেটাই খাওয়া হল। গভীর রাতের দিকে একটা ঠুক করে আওয়াজে ঘুম ভেঙে সুরজিৎ দেখল নন্দিতা তার পাশে নেই। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও সে তাকে দেখতে পেল না। ভাবল বাথরুমে গিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেও নন্দিতা এল না। সুরজিৎ এবার ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল। এদিক ওদিক খুঁজে দেখে, নন্দিতা পিছনের বাগানের দিকে একা একা বসে আছে। বিকেলবেলাতেও উপরের ঘরটা থেকে সুরজিৎ উঁকি দিয়ে দেখছিল নন্দিতা এই বাগানটায় ঘুরছে। কলাগাছটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। নন্দিতা মুখ তুলে তাকাবার আগেই সে সরে এসেছিল। নন্দিতা তাকে দেখতে পায়নি। সুরজিৎ এগোতে এগোতে শুনল নন্দিতা যেন গুনগুন করে কথা বলছে। বাইরে তখন নিকষ অন্ধকার।
সুরজিৎ পিছন থেকে গিয়ে নন্দিতার কাঁধে হাত রেখে বলল – কী রে! কী কথা বলছিস?
নন্দিতা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল । বলল – অ্যাঁ নাঃ কিছু বলছিলাম না তো! এমনিই বসে ছিলাম।
সুরজিৎ কিছুক্ষণ নন্দিতার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলল – এতো রাতে এখানে বসে তুই কী করছিলি?
নন্দিতা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল – তোর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
সুরজিৎ একটু ফ্যাকাশে হেসে বলল – অপেক্ষা! তুই তো আমার পাশেই শুয়েছিলি।
নন্দিতা বলল – বা রে! তুই যে বললি রাতের বেলায় ছাদে নিয়ে যাবি।
সুরজিৎ আমতা আমতা করে বলল – হ্যাঁ – অ্যা – বলেছিলাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চল তুইও ঘুমোবি চল।
সুরজিৎ বলার পরেও নন্দিতা দাঁড়িয়ে রইল। সুরজিৎ বলল – চল মাইরি। রাতের বেলায় তোর এই ন্যাকামো আর ভাল লাগছে না।
সুরজিৎ আর কথা না বাড়িয়ে বেডরুমের দিকে চলল। নন্দিতা তার পিছন পিছন পা ঘসে ঘসে আসতে থাকল। খুনখুনে গলায় বিড়বিড় করে বলতে লাগল – তুই বললি আসবি – তুই বললি রাতের বেলায় – তুই বললি –
উপরে এসে নন্দিতাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজার সবকটা ছিটকিনি আটকে সুরজিৎ কয়েক পলক নন্দিতাকে দেখল। নন্দিতা বিছানায় এসে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। সুরজিৎ কিছুক্ষণ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল। তার ঘুম আসছিল না। নন্দিতার দিকে হাত বাড়িয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় সে বলল – ঘুমটা যখন ভাঙিয়েই দিলি তাহলে একবার দে, নাহলে ঘুম আসবে না।
নন্দিতা কোন কথা বলল না।
(চার)
পরদিন সকালে উঠে আবার নন্দিতার সেই একই বায়না – সি বিচে যাব।
সুরজিৎ কিছুক্ষণ নন্দিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল – কাল রাতে তোর কী হয়েছিল রে? তুই খুব অদ্ভূত ব্যবহার করছিলি। আদর করার সময়ও ঠান্ডা বরফ মেরে গেছিলি। তোর ব্যাপারটা কী?
নন্দিতা কিছু না বলে অনেকক্ষণ জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। তার বলল – একটা কথা বলব, কাউকে বলবি না তো?
সুরজিৎ কোন উত্তর না দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে নন্দিতাকে ভালই চেনে। সুরজিৎ জানে সে কিছু না বললেও নন্দিতা কথা বলবে। নন্দিতা সুরজিতের দিকে তাকিয়ে বলল – আমি তখন খুব ছোট জানিস তো, সেই সময় আমার সঙ্গে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছিল।
সুরজিৎ চোখ সরু করে সিগারেটে টান দিতে দিতে নন্দিতার কথা শুনছিল। নন্দিতা বলে চলেছিল – আমাদের একটা গ্রামের বাড়ি ছিল। পরে সেটা বিক্রি দেওয়া হয়। বলা যায় আমার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটার কয়েক মাস পরেই বাড়িটা বিক্রি করা হয়। বাড়িটা ছিল দেওঘরের এক প্রান্তে। এক গরমের ছুটিতে বাবা মায়ের সঙ্গে সেখানে গিয়েছি। আমি যখন ছোট ছিলাম তখনও দেওঘর, দুমকা, গোড্ডা, জামতাড়া, শিমূলতলা এসব জায়গার একটা নিজস্ব ক্যারেকটার ছিল। অ্যান ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম।
আমাদের বাড়িটা ছিল দেওঘর থেকে দুমকা যাওয়ার পথে একটা দিকশূন্যপুরের রাস্তার পাশে। মূল শহরের একটু বাইরে। সেই রাস্তার দু পাশেই থাকা ড্যানচি বাঙালীবাবুদের ফেলে আসা খাঁ খাঁ করা বাড়িগুলো রয়েছে। গ্রীষ্মের নিঃস্তব্ধ দুপুরে সেই বাড়িগুলো বিষণ্ণভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। গুটিসুটি শীতের রাতে সেগুলোর আঙিনায় থাকে অচিনপুরের নৈশব্দ।
একদিন গরমের দুপুরে মা ঘরে ঘুমোচ্ছে। বাবা গিয়েছে জশিডি জংশনে কোন একটা কাজে। আমি সারা বাড়িতে টইটই করে ঘুরছি। ওই ছোট ছেলে মেয়েরা যেমন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের সামনের বাড়িটা আমি বরাবরই ফাঁকা দেখে এসেছি। পুরনো বাড়ি। গাদাগুচ্ছের পাতা পড়ে থাকে। কেউ সেই বাড়িতে কোনদিন থাকে না। অনেকদিন আগে সেখানে একটা অপঘাত মৃত্যু হয়েছিল। সবাই বলতো ওই বাড়ি অভিশপ্ত।
সেদিন গরমের ওই দুপুরটাতে আমি হঠাৎ দেখলাম ওই বাড়ির উঠোনটাতে কী যেন একটা ঘটছে? একটা গাছের পাতা হঠাৎ করে মাটি থেকে হাত তিনেক উঠে ঘুরপাক খাচ্ছে আবার পড়ে যাচ্ছে। ঘুরপাক খাচ্ছে, আবার পড়ে যাচ্ছে। আমি সন্মোহিতের মতো সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
আমি যেতেই পাতাটা ঘুরপাক খেতে খেতে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়িটার দিকে চলল। যেন আমাকে কেউ হাত ধরে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, আমিও তেমনভাবে সেই পাতার দিকে চললাম। ধুলোয় ঢেকে থাকা বারান্দায় পাতাটা বারকয়েক ঘুরল, তারপর সেটা ঢুকে পড়ল অন্দরমহলে। অন্দরমহল থেকে ঘেরা উঠোন পেরিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে শেষ অবধি সেটা এসে থামল বাড়ির পিছনের শুকনো পাতা ঢাকা মজা একটা পুকুররের সামনে।
দুপুরের একা হাওয়ায় পাতা ভাসতেই পারে। তার মধ্যে আশ্চর্য কিছু নেই। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, শুধু ওই একটি পাতাই ভাসছিল, আশেপাশের বাকি সমস্ত চরাচর শান্ত। তারা যেন অপেক্ষা করছে অন্য কিছুর। সেই পাতাটাকে দেখতে দেখতে সন্মোহিতের মতো আমিও কখন তার পিছন পিছন সেই মজা পুকুরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, নিজেও তা জানতেও পারেননি।
যখন খেয়াল হল, তখন দেখলাম, আমি একা। বাড়িটার খিড়কির দরজা কখন যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা ঘু ঘু এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। এমনিতে কোন শব্দ নেই। কিন্তু শুনলাম একটা শব্দ আছে। বছরের পর বছর যে পুকুরে কেউ নামেনি সেই নিস্তরঙ্গ জলে কিছু যেন ঘাই মারছে, সেখানে একটু একটু বুদবুদ উঠছে। মাছ নয়, সেই গভীর জলের আবছায়ায় দেখা যাচ্ছে চোখ, একজোড়া মানুষের চোখের মতো চোখ। আমার তখন আর পালাবার পথ নেই!
সুরজিৎ এবার হা হা করে হেসে উঠল। বলল – সে কী রে! তোকে ভূতে ধরার হিস্ট্রি আছে নাকি! আগে বলিসনি তো। বললে তোর কাছে আসার আগে দুবার ভাবতাম।
নন্দিতা আহত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। সুরজিৎ হাসতে হাসতে বলল – দেখিস আবার রাত বিরেতে আদর করতে গেলে ঘাড় টাড় মটকে দিস না।
নন্দিতা কোন কথা না বলে গোঁজ হয়ে থাকল। সুরজিৎ বলল – আচ্ছা বাবা আর রাগ করতে হবে না। চল সি বিচে ঘুরতে যাই।
(পাঁচ)
সুরজিৎ গাড়ি থেকে নেমে বিচের দিকে এগোল। নন্দিতা এর মধ্যেই জলে নেমে গিয়ে ছেলেমানুষের মতো জলের সাথে খেলছিল। সুরজিৎ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে সে ঠিক করে নিল কাল যখন তাদের ফিরে যেতে হবে, আজই তাহলে কথাগুলো নন্দিতাকে বলতে হবে। হয়তো নন্দিতা অবুঝ হয়ে যাবে। মেয়েরা অবুঝ হয়ে গেলে বড় অসুবিধা। এর আগেও সে দেখছে এই মধ্যবিত্ত মেয়েগুলোর একই সমস্যা। খুব তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়ে। আর প্রেমে পড়লেই বিয়ের ধান্ধা করে।
এটা বোঝে না ভালবাসা অনেকরকম হয়। আর ভালোবাসায় শরীর ব্যাপারটা শুধু একটা সামান্য অংশ। বুঝিয়ে বলতে হবে। এ মেয়েটা আবার একটু ছেলেমানুষ টাইপের আছে। এখনও বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে কথাবার্তার মধ্যে। ছেলেমানুষ মেয়েদের নিয়ে ঝামেলা আরও বেশি। একই ভুল তার দু বার করার ইচ্ছে নেই।
অনেকক্ষণ হুটোপুটি করে নন্দিতা উঠে এল। সুরজিৎ নন্দিতাকে একটা ডায়েট কোক দিল। নিজে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর গাড়ি চালাতে চালাতে বলল – তোকে কিছু কথা বলার আছে। একটু মন দিয়ে শোন আর বোঝার চেষ্টা করিস।
নন্দিতার মুখে সমুদ্র থেকে ওঠার পর থেকেই একটা হাসি লেগে আছে। সেই হাসি হাসি মুখেই কোক হাতে নিয়ে সে সুরজিতের দিকে তাকাল।
সুরজিৎ বলল – চিৎকার, চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করিস না প্লিজ। শোন, তুই এখন বড় হয়ে গেছিস, আর বড় হয়ে গেলে মানুষের জীবনে বিভিন্ন সম্পর্ক আসে। সেই সম্পর্কের বিভিন্ন রূপ হয়, নাম হয় –
(ছয়)
এখন অনেকরাত। সুরজিৎ দেখল নন্দিতা বিছানায় নেই। একবার ভাবল আজ সন্ধে থেকে বহুৎ জ্বালিয়েছে মেয়েটা। যেখানে যায় যাক, মরুকগে। কিন্তু একটু পরে আবার নন্দিতাকে খুঁজতে বেরোল। সুইসাইড ফাইড করে নিলে আবার ঝামেলা শুরু হবে।
এদিক ওদিক খুঁজে সে বাগানের কাছে বারান্দায় এসে দেখল মেয়েটা সেই কাল রাতের সেখানেই বসে আছে। চুপচাপ, চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার।
সুরজিৎ গিয়ে বলল – এভাবে মাঝরাতে আর বাওয়ালি করিস না প্লিজ। ঘরে চল।
নন্দিতা তার দিকে তাকাল। অন্ধকারেই সুরজিতের মনে হল, নন্দিতার চোখমুখ একদম বদলে গিয়েছে। সেই বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা আর নেই। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। সে যেন কিছু দেখছিল মন দিয়ে।
সুরজিতের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে নন্দিতা বলল – কী নাম ছিল রে মেয়েটার?
সুরজিৎ একটু অবাক হয়ে তাকাল। কিন্তু সে স্ট্রিট স্মার্ট মানুষ। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু ঢোঁক গিলে বলল – কো – কোন মেয়েটার?
নন্দিতা আগের রাতের মতোই খিলখিল করে হাসতে লাগল, হাসতে হাসতেই বলল – ওই রে, ওই মেয়েটার। কী নাম ছিল ওর? আমাকে তোর সব কথা ও বলেছে, ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাটা, তারপর মাটিতে পুঁতে ফেলার কথাটা। শুধু ওর নামটাই বলছে না। তুই – ই বল না প্লিজ।
কলাগাছটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল নন্দিতা। একটা সবুজ পোষাক পরা গাছ। ঘন কালো পাতার চুল। হাওয়ায় আলতো আলতো দুলছে। সুরজিতের কপাল ঘামতে লাগল। তার গলাটা শুকিয়ে আসছে। বাইরে তখন ছন্নছাড়া চাঁদের আলো। চারিদিকে অদ্ভূত একটা ধুপের মতো মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। এই পারফিউমটাই তো সে মাখত ।