• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় ঝুমা চৌধুরী

বেদরদি বালম

“এখন আবার কোথায় বেরোচ্ছো!!” সাধু প্রশ্ন ছুড়ে দিলো মিলির দিকে।এক আগুন চোখ নিয়ে মিলি উত্তর দিলো ” মরতে,আবার কোথায়!” সাধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মিলির দিকে।মিলি বলে চলে “তোমার আর কি বলো!! চাল জলের জোগাড় তো আমাকেই করতে হয়।” মৃদু স্বরে সাধু বলে “আজ কাজের বাড়ি যাবে না?” “না” বলে কাঁধে ব্যাগটা ফ্যালে মিলি। চার বাড়ি কাজ করে কটা পয়সা আসছে?রমলা মাসী গেঞ্জি কারখানার কাজের কথা বলেছিলো।কাজটা দেখে আসি।” তেড়েমেরে ওঠে সাধু, “ছিঃ ছিঃ ওইখানে তো সব ছোটোলোক বাড়ির লোকেরা কাজ করে!!” মিলি ততোধিক গলা চড়িয়ে বলে “ওহো হো!তাহলে লোকের বাড়ি এঁটো বাসন বুঝি ভদ্দরলোকেরা মাজে??এক পয়সা রোজগারের মুরোদ নেই তার আবার ভদ্দরলোক বউ দরকার!শোনো বেরোনোর মুখে মাথা জ্বালিয়ো না আমার।” খোলা দরজা দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো মিলি।বোকার মতন চেয়ে রইলো সাধু।
একা ঘরে ভীড় করে কতো বসন্ত দিন,গ্রীষ্মের বিকেল, শীত কাঁপা ভোর। মিলির সাথে প্রেম।সাইকেলের সামনে মিলিকে নিয়ে রাস্তায় চক্কর।তারপর পালিয়ে বিয়ে শুঁড়ি পাড়ার কালি মন্দিরে। মিলি তখন ক্লাস এইট। সাধু তখন কাজ করতো জুট মিলে।নিজেদের ছোট্টো একটা দুকামরার বেড়ার বাড়ি।সেখানে কেটেছে সাধু আর মিলির ২ বছরের দাম্পত্য।ভাব ভালোবাসা খুনসুটি ঝগড়া।মিলি সকালে উঠে রুটি তরকারি করতো, সাধু খেয়ে মিলে যেতো। দুপুরে ভাত নিয়ে যেতো মিলি। সন্ধ্যের সময় ফিরে দেখতো মিলি পরিপাটি করে সেজে রান্না ঘরে রাতের খাবার বানাতো। মিলির গা দিয়ে চুল দিয়ে মিষ্টি একটা গন্ধ বেরোতো। রাতে সাধুর বুক লেপ্টে ঘুমিয়ে পড়তো মিলি।ভোরের আদরে ওরা খুঁজে পেতো নিজেদের।
তারপর সেদিনটা এলো।মিলি দুপুরে ভাত নিয়ে গিয়ে দেখে কারখানার গেটে খুব ভীড়।এম্বুলেন্স। স্ট্রেচারে অজ্ঞান অবস্থায় রক্তাক্ত সাধু।তিন দিন পরে যখন জ্ঞান এলো বাঁ পাটা আর নেই।কাজটা গেলো।কিছু টাকা পয়সা মালিক যা দিয়েছিলো মাস সাতেক চললো।মিলি লোকের বাড়ি কাজে নামলো। কেমন যেনো বদলে যেতে লাগলো মিলি আস্তে আস্তে!বদলে যাওয়া মিলির সাথে পেরে ওঠেনা সাধু।নয়তো কেউ গেঞ্জি কারখানায় কাজ নেই!!
সুবোধ মল্লিক, গেঞ্জি কারখানার মালিক।বয়েস বছর ষাটেক হবে।আপদমস্তক দেখছে মিলিকে।যেনো মাপছে।অস্বস্তি হচ্ছিলো মিলির।রমলা মাসী কে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে সুবোধ বাবু মিলিকে নিয়ে কারখানায় ঢুকলো কাজ দেখাতে।কাজ দেখানোর আছিলায় হাতে গায়ে যেনো শরীর ঠেলে নিয়ে আসছে। ওপরে উঠতে গিয়ে সিঁড়ির চাতাল ফাঁকা পেয়ে সুবোধ বাবু হাত চেপে ধরলো মিলির।গলা খেলিয়ে বললো ” আমাকে খুশি করলে মাসে শ,পাঁচেক বেশী পাবি।” দিকবিদিকশুন্য হয়ে মিলি বাঁ হাতে সুবোধ বাবুর গালে চড় বসিয়ে দিলো। রাগে গর্জন করে উঠলো সুবোধ বাবু “পা কাটা স্বোয়ামি কিছু তো দিতে পারেনা।তার আবার এতো দেমাক!!” চিৎকার করে উঠলো মিলি “পা কাটা স্বামীর মনটা বিকলাঙ্গ নয় রে। তুই তো মনেই বিকলাঙ্গ!ঠিকই বলেছিলো লোকটা এটা ছোটোলোকের জায়গা।” বেরিয়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে ছুটতে লাগলো মিলি।লোকটাকে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কি না বলে এলো! আহা!! না এই সব কারখানায় সে কাজ করবে না।এর চে দুবাড়ি বেশী খাটবে। দুটো তো পেট ওতেই হবে।বাড়ি পৌঁছে ঘরের দরজাটা খুলতেই আকাশ ভেঙে পড়লো মিলির মাথায়।মেঝেতে পড়ে আছে সাধু।ধারালো দাঁ টা হাতে তখনও ধরা। গলার নলি কেটে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মিলি চিৎকার করে সাধুকে বোঝাচ্ছে, সে আর কারখানায় যাবে না, সে আর মুখ ঝামটা দেবে না, সে আর তাকে খাওয়ার খোঁটা দেবে না।
বাইরের একফালি উঠানে বাঁশ বাঁধা শেষ হলো সবে। কাঁটাছেড়া শরীরটা পুলিশ নিয়ে গিয়ে আরোও কাঁটাছেড়া করেছে।ওরা সবাই মিলে সাধুকে কাঁধে তুলে নিয়েছে।ওরা চলে যাচ্ছে খই ছেটাতে ছেটাতে। আর পাড়ার বিধবারা তাকে টানতে টানতে পুকুর পাড়ে এনে তার হাতের শাঁখা ভাঙছে, জলের ঝাপটা মেরে মেরে ধুয়ে দিচ্ছে সিঁদুর।মিলি শোধবোধ শূন্য হয়ে কি যেনো এক সুর বাঁধছে…
“তু হামকো শাড়ি দিলি না
সোনা দিলি না
সুখও দিলি না
তু আমার কেমন মরদ, মরদ হলি না…..”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।