গল্পকথায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

একতরফা

সকালবেলায় উঠেই গাছে জল দিবি। পাখিটাকে খাওয়াবি। পাখিটা কাঁচা লঙ্কা খায়। কিন্তু সাবধান! বেশি ঝাল লঙ্কা হলে তোর আঙ্গুলেই ঠুকরে ঠুকরে রক্ত বের করে দেবে। রোববার সাদা কাপড়গুলো ধুয়ে ব্লিচ করে দিবি। বিশেষ করে সাদা অন্তর্বাস আর রুমাল ইত্যাদি। ওগুলোতে তেলতেলে হলদেটে দাগ হয়ে যায় নইলে। ছাদে উঠে দড়িতে শুকোতে দিবি। কিন্তু কখনই খালি মাথায় রোদ্দুরে যাবি না।
খুব তো মাথা নাড়ছিস। রঙ্গিন কাপড়গুলোতে একেবারেই ব্লিচ করবি না, রোদ্দুরেই দিবি না। ছায়ায় শুকোতে দিবি সব সময়।
কুমড়ো আর লঙ্কাগুলো একসাথে ভেজে রাখবি মুচমুচে করে। টমেটো থেঁতো করবি। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর সস হবে তাতে। সব কাজকর্ম শেষ হলে নিজের জামাকাপড়গুলোও সাবান জলে ভিজিয়ে রাখবি নইলে দাগ তোলা মুশকিল। আর সেলাই করার জন্য থান কাপড়গুলো কেনার আগে ভালো করে দেখে নিবি তাতে খুব বেশি মাড় দেওয়া আছে কিনা। নয়ত পরে একবার ধুলেই ন্যাতা হয়ে যাবে। ঐ কাপড়ের জামাগুলো আর গায়ে দেয়া যাবে না।
আবার মাথা নাড়ছিস! যেন কতো বাধ্য! তোকে আর আমি চিনি না!
চাল ডালগুলো যদি আগে থাকতেই ভিজিয়ে রাখিস তাহলে সেদ্ধ হতে অনেক কম সময় লাগবে। গ্যাস খরচা বাঁচবে। একই সঙ্গে চিকেনটাও অন্তত একবেলা ম্যারিনেট করতে দিবি। যত ম্যারিনেট করবি ততোই সুস্বাদু হবে মাংসটা। আর খাবার সময়েই খুব সাবধানে খাবার নাড়াচাড়া করবি। যাতে মাংসের টুকরো বা আলুটা কব্জা করার সময়ে কোনমতেই যেন অন্যের গায়ে ছিটকে গিয়ে না লাগে।
আবার মাথা নাড়ছিস, যেন কতো বাধ্য মেয়ে! হাড় পিত্তি জ্বলে যায়!
চুল খুলে উড়নচণ্ডী রাস্তার মেয়ের মতো হাঁটবি না। বিশেষ করে শনিবারে। পেত্নী ভর করে। বস্তির আজেবাজে ছেলেগুলোর সঙ্গে কথাই বলবি না। রাস্তার কাটা ফল একেবারেই খাবি না। ওতে মাছি বসে। মাছি রোগের ডিপো। তার ওপর তোর পেছু পেছু মাছিও এসে বাড়িতে ঢুকবে। কতো আর জাল দিয়ে আটকাবো। আর কীভাবে জামার বোতাম সেলাই করতে হয় দেখে নে। আর সেই বোতাম অনুযায়ী কীভাবে বোতামঘর বানাতে হয় তাও শিখে নিস।
সমানে মাথা নেড়েই চলেছিস? যেন কতো বাধ্য!
হ্যাঁ, আমি এসব তোকে বলছি, কারণ আমি চাই না তুই কিছুতেই উড়নচণ্ডী মেয়েদের মতো হোস অথচ সেটা হতেই যেন তোর যতো আগ্রহ। তারপর দেখ, জামাকাপড়গুলো এমনভাবে ইস্তিরি করবি যাতে একটুও ভাঁজ না পড়ে। কীভাবে শাড়ি পাজামা সালোয়ারগুলো ইস্তিরি করতে হয় যাতে কোন ভাঁজ না পরে, সেটা জানাটা একটা আর্ট, সবাই পারে না। আরও শিখে নিবি, কীভাবে পেছনের বাগানে মিস্টি কুমড়ো আর ঢ্যাঁড়সের চাষ করতে হয়। অথচ একেবারে ঘরের লাগোয়া কোন সবজি বাগান নয়, তাহলে লাল পিঁপড়ের প্রচণ্ড উপদ্রবে টিঁকতে পারবি না। সবচেয়ে ভালো হয় অন্য সবজির সঙ্গে লঙ্কার চাষ করলে কারণ, তাহলে আর লাল পিঁপড়ে ধারে পাশে থাকতে পারবে না।
মুখে বলছিস তাই করবো! আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না!
হ্যাঁ মানকচু সম্পর্কেও সাবধানতা জরুরি। প্রচুর জল দিতে হবে গাছে। নইলে এতো গলা চুলকোবে যে সেই কচু মুখেই তোলা যাবে না । ঘরের কোনাটা কীভাবে মুছবি দেখে নে। বাড়ির কোনার ময়লা পরিষ্কার করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। গোটা বাড়িটা কীভাবে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে সেটাও মন দিয়ে শিখে নে। ব্যালকনি পরিষ্কার করা শেখাটাও জরুরি। সব কিন্তু আলাদা টেকনিক। আরও আছে। কোন পুরুষ মানুষ তোর কাছে ভীষণ অপছন্দের হলেও সেটা তার কাছে একেবারেই প্রকাশ না করে কীভাবে হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা করা যায় এটাও একটা শিক্ষণীয় আর্ট। যে লোকটাকে একেবারে অপছন্দ করিস তাকে দেখেও কীভাবে হাসবি শিখে নে। ঠিক এই ভাবে, বুঝলি? আর যাকে তোর খুবই পছন্দ তাকেই দেখেই বা কীভাবে হাসবি সেটাও জানা অত্যন্ত জরুরি। সেটা এই রকম! এদিকে তাকা।
আবার বলে আচ্ছা মা! আমি তো কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারি না। কী যে আছে তোর কপালে!
চায়ের টেবিল কীভাবে সাজাবি, কোথায় ফুলদানি রাখবি কীভাবে ডিনারের টেবিল সাজাবি, লাঞ্চের টেবিল সাজাবি এ সমস্তই শেখার বিষয়। আমি একটা বই কিনে এনেছি শহর থেকে। যে সমস্ত লোকেরা তোকে ভালো করে চেনে না, তাদের নজরে পড়ার একমাত্র উপায় হল আলাদা হতে শেখা। ভিড়ের মধ্যেও আলাদা থাকবি বুঝলি। চেহারা পোশাক ব্যবহার রুচি সবই যেন আর পাঁচটা মেয়ের থেকে আলাদা হয়। আর হ্যাঁ, সব সময় পুরুষের মন যুগিয়ে কথা বলবি কিন্তু সেটা বোকার মতো বলবি না। ছ্যাবলা মেয়েদের পুরুষেরা একেবারেই পছন্দ করে না বুঝলি।
আবার বলে ঠিক আছে মা! ভালো করে শোন।
তোকে তো বারবার সাবধান করে দিচ্ছি, একেবারেই খেলো মেয়েদের মতো হবি না, যেটা হবার জন্য তুই আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিস! তোকে যে কেউ দেখামাত্রই মাথায় তুলে ধেই ধেই করে নাচবে এমন তো নয়! তার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে, সময় দিতে হবে। প্রত্যেকদিন স্নান করে পরিষ্কার কাচা ইস্তিরি করা জামাকাপড় পরে ধোপদুরস্ত থাকার চেষ্টা করবি। আর যখন তখন বাইরে বেরিয়ে গিয়ে পার্কে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলবি না। একটু আধটু ব্যাডমিন্টন বা বাস্কেট বল খেলতে পারিস। কিন্তু নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে। সব সময় মনে রাখবি সবসময় যে তুই কিন্তু একজন মেয়ে।
আর পরের গাছের ফুল কখনই তুলবি না বা পাতা ছিঁড়বি না। রোজ মর্নিং ওয়াকের নাম করে বেরিয়ে তুই অন্যের গাছে ফুল তুলিস। তুই আর তোর বন্ধু রেবা মিলে এই অপকর্মটি করিস! অনেকেই দেখেছে আর আমার কাছে নালিশ করেছে। এটা মোটেই ভদ্রলোকের মতো কাজ না। আর কাক দেখলেই ঢিল ছুঁড়বি না। কাক মারলে পরের জন্মে কাক হয়ে জন্মাতে হবে মনে রাখিস। কিভাবে পিঠে বানাতে হয়, বড়ি আর আচার দিতে হয় সব আমার কাছ থেকে শিখে নিবি। তোকে তো ডেকে ডেকে মোটেও কাছে পাই না। দিনে দিনে ধিঙ্গি হচ্ছিস, এসব আর শিখবি কবে? কতো কী শেখার আছে! নুন গোলমরিচের জন্য ছোট ছোট শিশি জোগাড় করে রাখতে হয়। তাদের গায়ে নানা কারুকাজ করতে হয়। সেটাও একটা সুন্দর হাতের কাজ। সর্দিকাশির হাত থেকে বাঁচতে হলে আদা বাসক পাতা মধু দিয়ে ক্বাথ বানাতে হয়। এটাও শেখার জিনিষ। না চাইলেও যদি পেটে বাচ্চা চলে আসে অথবা শরীর যদি বাচ্চার ধকল সইতে না পারে তবে কোন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে বা কী কী করতে হবে, আর বাচ্চা যদি স্বাগত হয় তবেই বা কী করে তাকে নিরাপদে ভূমিষ্ঠ করানো যায় বা সেই বাচ্চা কে কী কী খাওয়ানো উচিত, কেমনভাবে যত্ন নেওয়া উচিৎ এগুলোও শেখার মতো বিষয় আর তোকে আমি এইসব যে আর কবে শেখাবো, কে জানে!
এছাড়া আরও আছে। কিভাবে পুরুষমানুষকে তোর দিকে আকৃষ্ট করতে হয় সেটাও জানা দরকার। সোজা কথায় ছেলেদের কীভাবে ঘোল খাওয়াবি, সেই কায়দা! আবার পুরুষমানুষও কীভাবে মেয়েদের পটায় সেটাও জেনে নিতে হবে যাতে করে যে কেউ তোকে পটাতে না পারে। পুরুষমানুষকে হাত করা বা ভালোবাসা এসমস্তই এক গভীর শিল্পকলা। তার অনেক কায়দা কানুন আছে। সেই কায়দাগুলোতে ঠিকঠাক কাজ না হলে অন্য কোন কায়দা প্রয়োগ করতে হবে সেটাও জেনে রাখতে হবে।
আরও কত কি আছে জানার। খুব জরুরি ক্ষেত্রে কীভাবে থুতুটা প্রবল হাওয়ার মধ্যেও দূরে ছুঁড়ে ফেলতে হয় যাতে কেউ টের না পায়, অথচ কোনরকমে হাওয়ার ঝাপটায় সেটা উড়ে এসে গায়ে এসে না লাগে সেটাও দেখার।
অভাবের সংসারে কীভাবে খাবার দাবার দেখেশুনে কিনতে হবে, দরকার পড়লে ধার বাকিতে হলেও, সেটা খুব বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝে নিতে হবে। বুদ্ধি করে চলা ছাড়া আমাদের আর উপায় কী বল। যেমন দোকান থেকে পাউরুটি কেনার সময়ে পাউরুটিটা খুব ভালো করে চেপে ধরে আবার ছেড়ে দিয়ে দেখতে হবে স্পঞ্জের মতো পুনরায় আগের মতো আকৃতিতে সেটা ফিরে আসছে কি না। তবেই সেটা নেওয়া উচিত নচেৎ নয়, এটা মনে রাখতে হবে।
কি বললি? দোকানদার যদি পাউরুটি ধরে দেখতেই না দেয় বা পাউরুটি ধরে চাপাচাপি করলে রেগে যায়?
আরে এতক্ষণ ধরে তোকে কী শেখালাম। একটা পাউরুটির দোকানদারকেই যদি তুই কবজা করতে না পারিস তবে ঘর সংসার করবিই বা কী করে আর স্বামীকেই বা বশে রাখবি কীভাবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।