• Uncategorized
  • 0

গদ্যে সরোজ দরবার

যে খেলার যা নিয়ম

নটে গাছটি প্রায় মুড়িয়েই যেতে বসেছিল। এমন সময় গোল বাধল। কূটতর্ক তুলে একজন বলল, যে-ছেলে ম্যাচে হলুদ কার্ড পেয়েছে, তাকে ম্যান অফ দি ম্যাচ করা কতটা যুক্তিযুক্ত। নৈতিকতায় বাধবে না! এতে করে কি প্রমোট হয়ে যাবে না যে, ম্যাচ জিততে হলুড কার্ড পাওয়াতেও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়!
কথাটা যে এতক্ষণ কারো মাথায় আসেনি এমন নয়। কিন্তু এটাও যে একটা বলার মতো কথা, তা কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেননি। কারণ, ম্যান অফ দ্য ম্যাচ যাকে দেওয়া হচ্ছিল, সে গোলও তো করেছে। তার গোলেই তো ম্যাচ জিতেছে। তাহলে? তাহলে সে সেরা হবে নাই-বা কেন?
তা সত্ত্বেও নৈতিকতার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। বিশেষত যদি নৈতিকতার ধার যদি নাই-ই মাড়ানো হবে, তাহলে হলুড কার্ড ব্যবস্থাটাই বা আছে কেন!
ফলে যে-প্রশ্নটার মীমাংসা হচ্ছে না, তা হল, গোল করাই কি একমাত্র মোক্ষ? কিংবা ম্যাচ জেতানো! না-হয় না জিতলি ম্যাচ। না হয় আড়াইশো বেগুন কাপড়ের থলেয় ঢুকিয়ে ভেজা ফতুয়ায় গা সপসপে বাড়ি ফিরলি। না-হয় ফেরার পর দেখা গেল তার মধ্যে দু-খানা কানাই বেরিয়েছে। জীবন কী এমন আকাশগঙ্গা রে ভাই! এই কানা বেগুন, কানকো ওঠা মাছ, এই এটিএম-এর ঘড়ঘড় অন্তে টাকা বেরিয়ে না-আসা এবং আবার ঠেঙিয়ে পরের এটিএম যাওয়া, এই যে বাস মিস করে সময়ে অফিস ধরার তাড়ায় উবর বুক করে চড়ে বসে ঘাড়ের ঘাম শুকোতে না শুকোতে দেখে ফেলা পঁইপাঁই করে ছুটে আসছে পরের বাস,- এসব কি জীবন নয়! সব্বাইকে সবসময় জিততে হবে, কে মাথার দিব্যি দিয়েছে! কিন্তু তাই বলে অপরকে ল্যাং মারবি কেন বাবা! হলুদ কার্ড কেন দেখবি!
এ-বড়ো জটিল সমস্যা! কিন্তু অন্যায় প্রস্তাব নয়। ফলে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।
অতএব পুরস্কার বিতরণী অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। যারা ম্যাচ জিতেছিল, তারা মুখ চুন করে বসে আছে। যেন, জিতে ঘোর অন্যায় করে ফেলেছে। অন্যদিকে যারা হেরেছিল, তারা তো হেরেইছে। তবু তারা এখন ফিলিং সব হার হার নয় উইথ উইনাটেড মধ্যবিত্ত ক্লাব এবং সিক্সটি নাইন আদার্স।
এর মধ্যে, এই কূট দোদুল্যমানতার মধ্যে, মারাত্মক চালটি ঝাড়লেন যে-লোকটা, মোদো বলে তার কিঞ্চিৎ সুনাম আছে। তো মদের গুণেই হোক বা অন্য যে-কারণে, এইরকম সময়ে তার আশ্চর্য মস্তিষ্কটি খুলে যায়। সে বলে, তবে যে বলেছিল, নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার! তাহলে, এই ছেলেটি হলুদ কার্ড দেখে কী এমন নৈতিক অধঃপতন ঘটিয়েছে যে তাকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ দেওয়া যাবে না!
বিবাদ দু-মুহূর্তের জন্য চুপ। কিন্তু আগুন তো। হাওয়ার চিলতে পেলেই জ্বলে ওঠে। বিবাদ বলে, কে বলেছিল? নাথিং ফেয়ার-মেয়ার ওইসব…
  • বলেছিল কেউ। হবে, তপন বা তথাগত। স্বপন বা সমাগত। তাতে কার কী! কী বলেছিল সেটাই তো আসল।
  • আঁজ্ঞে না।
  • মানে?
  • যে এসব বলেছিল, দেখতে হবে, সে কোন দেশের?
  • দেশ দিয়ে কী হবে?
  • তাতে বোঝা যাবে কোন দেশভঙ্গি থেকে সে, এ-কথা বলেছে?
  • দেশভঙ্গিটা আবার কী!
  • সেটা দেশপ্রেমিক হলেই বুঝতে। নও বলেই বুঝতে পারছ না।
  • কে বলল নই! তুমি ঠিক করে দেবে, আমি দেশপ্রেমিক কি না?
  • আলবাত দেব।
  • কী যোগ্যতা তোমার? দেশ বলতে তুমি কী বোঝা?
  • দেশ মানে দেশ। আর যোগ্যতা শুধু পরীক্ষায় পাশ করলেই হয় না। একজন সাধারণ মানুষকে এই চোখেই তো দেখ তোমরা এলিটিস্টরা!
  • সাধারণ মানুষকে আবার এর মধ্যে টানা কেন?
  • কারণ, তারাই ভোট দেয়।
  • তো?
  • তারাই সরকার গঠন করে।
  • তো?
  • তারাই বুঝিয়ে দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ কী চায়?
  • কী চায়?
  • চায় যে, ওসব ওয়ার-ফোয়ারের যুক্তি বাদ। আমার কথা শোনো…
  • কী?
  • ছেলেটিকে কিছুতেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ দেওয়া যায় না।
  • আচ্ছা বেশ।
  • শুধু তাই নয়। একটা নীতিশিক্ষা বলে ব্যাপারও তো আছে। ফলে ওর গোলও বাতিল হল।
হেরে যাওয়া দল এতক্ষণ ঝিম মেরে বসেছিল। এবার তারা তড়াক করে সামনে চলে এল। বলল, ওর গোল যদি বাতিল হয়, ম্যাচটা তো তাহলে আমরা এক গোলে জিতছি।
সকলেই, হাঁ হাঁ করে উঠল। ঠিক কথা। জয় তাহলে ওদেরই প্রাপ্য।
হারা দলের শিবিরে সঙ্গে সঙ্গে বাজি ফুটতে শুরু করল। জেতা দল বলল, মোড়লের কাছে যাবে। ততক্ষণে হারা দলের সবাই মহল্লায় মহল্লায় বাজির রোশনাই শুরু করে দিয়েছে। আহা কত আলো! দেখতে কার না ভালো লাগে! মোড়ল তখন নাতিকে নিয়ে বাজির ছেতরে ছেতরে যাওয়া দেখছিলেন। এমন সময় জেতা দল এল দরবার করতে। দেখামাত্রই মোড়লে চোঁয়া ঢেকুর উঠল। বুকের বাঁদিকে কেমন যেন একটা চিনচনে ভাব এল। কোনক্রমে তিনি বললেন, জনতার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বলে, ভিতরঘরে চলে গেলেন। তারপর জানলা খুলে আবার বাজি পড়ানো দেখতে লাগলেন। নাতিকে বসিয়ে নিলেন তাঁর কাঁধে।
এই সময়, জেতা দল হেরে গেল দেখে ক্ষিপ্ত কিছু লোক জানতে চাইল, নৈতিকতার ধুচুনাধারীটা গেল কোথায়? কে আগে এই প্রশ্ন তুলেছিল যে, হলুদ কার্ডকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ দিলে ডেকাডেন্সেরও মান থাকবে না!
সকলে মিলে লোকটাকে খুঁজতে বেরনো হবে ঠিক হল। কিন্তু তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে বলে মুলতুবি হয়ে গেল ব্যাপারটা।
তা ছাড়া এত আলোচনায় সকলে খুব ক্লান্তও তো হয়ে পড়েছিল। এমনিই ক্যাচাকেচিতে আট ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। বিনি পয়সার ওভারটাইম মোটেও কাজের কিছু নয়। বলি দেশে গণতন্ত্র, আইনকানুন এখনও তো একদম মরে যায়নি রে বাবা!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।