গদ্যে মৃদুল শ্রীমানী

আমার কথা

আমি যখন জন্মাই, সেটা ১৯৬৭ সাল। তখন বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ চলছে। চীনদেশের চেয়ারম্যান মাও জে দং সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছেন। তাঁর ভাবে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিরা রাতের আঁধারে দেওয়ালে আলকাতরা দিয়ে কত কথা লিখে ফেলছেন। উল্লসিত হয়ে অনেকে মুদি দোকানদারকে আর পুলিশের কনস্টেবলকে শ্রেণী শত্রু ঠাউরে খুন করে দিচ্ছেন। বিদ্যাসাগরের পাথরের মূর্তির মুণ্ডু ভাঙছেন। তার পরে পরে আমাদের বরানগরের পথ ধরে ঠেলাগাড়ি করে যুবকদের লাশ পৌঁছে গিয়েছে শিলাঘাটে।
দেখি নি। কিন্তু এতবার শুনেছি যে, ভুলতে পারব না চেষ্টা করলেও।

এখন যেমন দু চার চরণ লিখতে পারলেই কাব্য বিভূষণ হয়ে মঞ্চ আলো করে বসা যায়, আর লোকে মনে করে কবিতা লিখতে পারলে আর সমস্যা নেই, পুরস্কার আর মালা চন্দনে গোটা দেহটা ঢাকা পড়বে, আমাদের ছোটবেলায় সে সব ছিল না। আমাদের প্রিয় কবি জেল খেটেছেন। বন্ধুদের থেকেও লাইক পান নি। বরং বন্ধুরা বলেছে ফের যেন তুই যাস জেলে। আর আরেক প্রিয় কবি যক্ষ্মা রোগে ভুগে মারা গিয়েছেন। বিদেশী দুজন কবির নাম জানতাম, পাবলো নেরুদা আর নাজিম হিকমত। ওঁদের কবিতা পড়েও বুঝতাম কবিতা লেখা অন্যতম বিপজজনক কাজ। কবিরা ক্রান্তদর্শী। আর ক্রান্তি মানে জানতাম বিপ্লব। সে একটা রক্তক্ষয়ী ব্যাপার। এখনকার মতো লাল জামা নীল জামার কারবার সে সব দিনের কবিরা ভাবতে পারতেন না।

ক্লাস সিক্স অবধি জানতামই না রাজনৈতিক দল ব্যাপারটা কি, আর রাজনৈতিক হত্যা কি জিনিস। তখন আমি স্বপ্ন দেখতাম একদিন সুভাষচন্দ্র ফিরে আসবেন, আর এসে সব ঠিকঠাক করে দেবেন। ঠিক করে দেবেন মানে গরিব মানুষ বড়লোকের মোটরের তলায় চাপা পড়বেন না। খাওয়া দাওয়ার তালিকা থেকে ঘুষ শব্দটা বাতিল হয়ে যাবে।
বুঝতে চাইতাম না যে তিনি এলে স্বাধীন দেশে তাঁকে হয়তো ফাঁসিই দিত। মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। কিচ্ছুটি বলত না। তখন এসব ভাবতে শিখি নি। ভাবতাম অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম।

আমাদের বাড়ি ছিল অতি সাধারণ। লেখাপড়া আর সাধারণ স্বাস্থ্য ছাড়া অন্য কিছুর চর্চা হত না। বিকেলে আমরা যেতাম স্কাউট দলে। সেখানে
নিয়মানুবর্তিতা আর জাতীয়তাবাদ শেখানো হত। দেশসেবা করতে হবে এটা বোঝানো হত। আর প্রাথমিক চিকিৎসা, তাঁবু খাটানো, স্বনির্ভর হবার পাঠ দেওয়া হত। স্কুলে শুধু বই মুখস্থ পড়া। নিচু ক্লাসে শিক্ষক মশায়রা বইয়ের বাইরে কিছু উল্লেখ যোগ্য কথা বলেছেন বলে মনে পড়ে না। মনীষীদের কথা বলা হত, তবে তাঁদের সংগ্রামটা বাদ দিয়ে। তাঁরা যেন পূৰ্ণ মানুষ হয়েই জন্মেছেন। অথবা উল্কাপাতের সাথে ধরাধামে এসে পড়েছেন। একটা মানুষ যে নিজেকে নিয়ে হরেক রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে তবেই বড় হয়, আর ভুল হবার সম্ভাবনা যে কাজ করতে চাইলে যথেষ্ট বেড়ে যায়, এটা বোঝানো হত না।
সে সব দিনে টেলিভিশন ছিল না ঘরে ঘরে। আমরা ছোটো থাকাকালীন অন্যদের বাড়িতে টিভি দেখতে গিয়েছি, মনে পড়ে। সে রকম যেতে কেউ লজ্জা পেত না। এমন একটা ফিল্ম ছিল “সিস্টার”। ছবি দেখে অঝোরে কান্নাকাটি করার চল ছিল। মানুষের দুঃখ দেখলে হু হু করে চোখে জল এসে গেলে তাকে কেউ বোকা বলত না। দেশপ্রেম মানে ছিল দেশের জন্য যুদ্ধ করা। সে যুদ্ধ বন্দুক হাতে।

তখন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান নিয়ে খুব হৈচৈ হত। বড় বড় ফুটবল ম্যাচ চলার সময় রাস্তা শুনশান হয়ে যেত। তার পর কোন দল ম্যাচ জিতেছে সেই সূত্রে রাস্তায় হৈ চৈ। দড়ি দিয়ে এপার ওপার খাটিয়ে বড় বড় কচুপাতা ঝোলানো হত। মানুষ তীব্র প্যাশন থেকে ইলিশ মাছ কিনত। আমাদের বাড়ি ছিল নিস্তরঙ্গ। সেখানে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের ঢেউ এসে পৌঁছত না। বাবা ছিলেন মিতব্যয়ী। যুক্তিসংগত ক্ষেত্র ছাড়া তিনি অর্থব্যয় করতেন না।

দুর্গা ঠাকুর বিসর্জন হত কুঠিঘাটের গঙ্গায় আর সে সব দেখে নদীর জল ঘটে করে নিয়ে বাড়ি এসে বেলপাতায় “শ্রী শ্রী দুর্গা শরণম” লিখতে হত। মাটির তৈরী দোয়াতদানি আর খাগের কলমে লেখা। তার পর হোমিও ডোজ এ সিদ্ধি দেওয়া শরবৎ পান। মায়েরা গল্প করতেন কি কি করলে সিদ্ধির শরবতে সাংঘাতিক নেশা হয়। তামার পয়সা ঘষলে না কি অমন হয়। আর শরবতের পর বেশি মিষ্টি খেলেও বেশি নেশা হয় মায়েরা বলাবলি করতেন। বাড়িতে কোনো ধরণের নেশার চল ছিল না। মদ্যপানকে গর্হিত অপরাধ হিসাবে দেখা হত। ধূমপান বাবা জেঠারা কেউ কোনোদিন করতেন না। সেভাবে চা পর্যন্ত খাবার চল ছিল না বাড়িতে। নেশা যদি অতি খারাপ জিনিস তা হলে বারোয়ারি দুর্গাপূজার হিসেব লাল কালিতে ছাপিয়ে খরচের কলমে সর্বপ্রথমে সিদ্ধি কথাটি লেখা হত কেন কে জানে!
অনেক রাতে পাশের বাড়ির একটি পাঁড় মাতাল ফিরতে ফিরতে ভিয়েতনাম আর ইন্দোচীন নিয়ে স্খলিত কণ্ঠে কি সব বলতে বলতে ফিরতেন। ভয়ে কাঠ হয়ে সেটা শুনতে পেতাম। তখনো শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামে কবির কথা, তুষার রায় নামে কবির কথা শুনি নি।

নদীর ধারের রাস্তাকে যে স্ট্র্যান্ড  বলে সেটা ইংরেজি কবিতার সাথে বাস্তবে মিলে গিয়েছিল। কুঠিঘাটের গঙ্গাতীরে ছিল হরকুমার ঠাকুর স্ট্র্যান্ড । আমাদের বাল্যকালে বরানগর থানাটি ছিল গঙ্গা তীরে। ভৌগোলিক ভাবে সেটা বরানগরের একেবারে একটেরে। অমন হবার কারণ কি ছিল কে জানে। ছুটির দিনে সকাল বিকাল গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটার সুযোগ হলেই থানার হাজতটা চোখে পড়ত। হাজতের ভিতর মাঝে মধ্যে দু একজন বসে থাকত। লোহার মোটা গেট আর ভারি তালার আগল ডিঙিয়ে তাদেরকে খুব দুর্বৃত্ত মনে হত না। হাজতটা যে আর যাই হোক, জেলখানা যে নয়, সেটা জানতে সময় লেগেছিল।

সেই সব দিনে, সত্তর দশকের শেষে বাংলার কল কারখানাগুলো নষ্ট হবার বাকি ছিল। বরানগরে চারদিকে কারখানা। আলমবাজারে জুটমিলে বিস্তর লোক কাজ করত। বেঙ্গল ইমিউনিটিতে শিফট চেঞ্জ এর সময় খানিকক্ষণ রাস্তা দিয়ে চলা যেত না। অনেক শ্রমিক কাজ করতেন। সিঁথি মোড় সার্কাস ময়দানে ছিল কার্টারপুলার নামে ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। কাশীপুরের অস্ত্র কারখানা ছিল বিখ্যাত। আর ছিল ব্যাটারি ফ্যাক্টরি। গঙ্গার ধারে হরকুমার ঠাকুর স্ট্র্যান্ডে একটি সাবান কারখানা আর একটি রং কারখানা দেখেছি। আমাদের কালিদাস লাহিড়ী লেনের মুখে একটি কারখানা ছিল। নাম ছিল বরানগর ব্রাস ফাউন্ডরি। লোকমুখে কালীবাবুর কারখানা না কি একটা বলা হত, সে আর আজ মনে নেই। সারাদিন একটা বিরাট লোহার চাকা ঘুরে চলত মনে আছে। বামফ্রন্টের উপর্যুপরি জয় আর নিরবচ্ছিন্ন জনপ্রিয়তায় বরানগরের সব কারখানা গুটিয়ে গেল।

সত্তর দশকের শেষেও ঠাকুর দেখতে যেতাম বাবা মায়ের সাথে। বরানগরে সে সময় বেঙ্গল ইমিউনিটি চমৎকার দুর্গাপূজা করতেন। প্রতিমার আয়তনে, আভরণে, আলোকসজ্জা ও নান্দনিকতায় তাঁদের পুজো লোক টানত খুব। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার লোক থাকত। সেই পূজায় ধুনুচি নাচ দেখে অবাক হতাম।
গঙ্গার ধারে রঙ কলের কাছে ছিল সাধন সমর আশ্রম। তাঁদের পূজা ছিল সম্পূর্ণ অন্য ঘরানার। সেখানে দেবী ছিলেন সহজ সুন্দরী। তিনি কৃষক রমণীর সহজ সরল বাহুল্যহীন বেশে সজ্জিতা। কোনো অস্ত্র টঙ্কার তাঁর ছিল না। শাদা শাড়িতে লাল পাড়ে তিনি অসামান্য সুন্দরী। শান্তি আর স্বস্তি আর মাতৃত্ববোধ সর্বাঙ্গে বিকশিত। এই সাধন সমর আশ্রমের পূজা অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠার সাথে হত বলে শুনেছি। বাবা এই পূজাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন।
দেবী ওখানে রণরঙ্গিণী খড়্গ কৃপাণধারিণী ছিলেন না কখনো। অসুর ও তার কাছে ক্ষমার্হ। আমার বিপক্ষে থাকলেই যে তাকে কোতল করতে হবে, এই কিলার ইনস্টিংক্ট সেই সাধন সমর আশ্রমের দুর্গার ছিল না।
১০
আমাদের বাড়িতে রাজনীতির চর্চা হত না। রাজনীতির লোকেরা ভোটের দিনগুলোতেও আমাদের বাড়িতে গল্পগাছা করতে আসতেন না। বাড়িতে কে আসবেন না আসবেন, তা ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। স্কাউট দলের তরফে কখনো কখনো অনেক সিনিয়র দাদারা কেউ আসতেন। আমাদের গৃহশিক্ষক ছিল না। বাবা মা যেটুকু পড়াতে পারতেন, তাতেই কাজ মিটে যেত। । বাবা পছন্দ করে পড়ার বাইরের বই দুই চারটা করে কিনে এনে দিতেন। বাড়িতে মজুত গল্পের বইয়ের সংখ্যা ছিল তেমন বলার মত নয়। যে কয়খানি মা বিয়েতে পেয়েছিলেন, তা অজস্রবার করে পড়ে ফেলেছিলাম। বাইরের জগতের তরঙ্গ বাড়ির মধ্যে বিশেষ পৌঁছত না। একটা রেডিও ছিল। মাতামহ তাঁর কন্যাকে বিবাহের কিছু পরে উপহার দিয়েছিলেন। সেটার লাইসেন্স রিনিউ করাতেন বাবা। সেটিতে মা বাবা গান শুনতেন। নাটক শুনতেন। শিশুমহল হত রবিবারে। মন দিয়ে শুনতে হত। ভালোই লাগত। আরো ভাল লাগত ফাঁক পেলেই রেডিওটির পিছন খুলে কি আছে সেখানে, দেখতে।
মা গান শুনতে ভালবাসতেন। আধুনিক গান। আরতি মুখোপাধ্যায়, সুমন কল্যাণপুর এই নামগুলি মনে গেঁথে আছে। খবর কি শুনতাম? শুনেও কি বুঝতাম?
এর মধ্যে বাবা একদিন বলেছিলেন হেমন্ত বসুকে হত্যার কথা। নিরভিমান সহজ সরল মানুষ হেমন্ত বসুকে রাজনৈতিক শত্রুতায় পিঠে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছিল। হেমন্তবাবু না কি আততায়ীদের বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে মারছ কেন, আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নি।”
হেমন্ত বাবু কি জানতেন না যে রাজনৈতিক শত্রুতার যুগে আততায়ী ভাড়া করা হয় খুন করার জন্য। খুন আততায়ীর পেশা। তার সাথে যুক্তি ও ভাবাবেগের কোনো সম্পর্ক নেই।
১১
সত্তর দশকের শেষেও বাংলায় দেওয়াল লিখনের কিছু গুরুত্ব ছিল। আমরা দেওয়ালে ভোট প্রচার ছাড়াও আরো কিছু জ্ঞানগর্ভ কথা লেখা দেখতে পেতাম। তার একটি হল “শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি।” আর একটা কথা ছিল “ভুখা মানুষ ধরো বই। ওটা হাতিয়ার।” সমাজ পরিবর্তনের দিকে জোর দেওয়া হত। যখন বোঝা গেল যে বামফ্রন্ট পর পর জিতেই চলবে, তখন দেওয়ালে এই সব জ্ঞানগর্ভ কথা লেখার প্রয়োজন হারিয়ে গেল। তখন খুব যত্ন করে আর্টিস্ট দিয়ে হলদিয়া পেট্রোকেম ও বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুতের কথা সব জায়গায় লেখা হত। কিন্তু একটি আধুনিক কারখানা সুনিশ্চিত ভাবেই পুঁজি নিবিড় হবে, তা কি করে লাখো মানুষের হাতে কাজের যোগান দেবে বুঝতে পারতাম না। তবে দেখেছিলাম হলদিয়া নিয়ে সুদীর্ঘকাল টালবাহানা চলেছিল। আর বক্রেশ্বর নিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে অপচয়ের কারণে রক্তদান আন্দোলন একটু হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। বামপন্থী ভোট যত সুনিশ্চিত হতে লাগল, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বামপন্থী বোধ ও বিবেক মার খেতে লাগল। তখন বুঝতাম পাওয়ার করাপ্টস।

১২

রাজনীতির লোকেরা উচ্চরুচিপূৰ্ণ হবেন, এটা শুনতে যত ভাল, বাস্তবে এর অভাব ততখানি। রাজনৈতিক সৌজন্য কাকে বলে কোনোদিন দেখিনি। আমার অল্প বয়সে, ইন্দিরা গান্ধী যখন জীবিত, তখন তাঁর মুখের সাথে একটি সর্প দেহ জুড়ে দিয়ে নিচে একটি রবীন্দ্র কবিতা লেখা হত। “প্রান্তিক” কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি। “নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। শান্তির ললিত বাণী শোনাইছে ব্যর্থ পরিহাস।” কবিতা রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু একজন মহিলাকে ভারতীয় সমাজে “নাগিনী” শব্দে চেনানো রাজনৈতিক সৌজন্য হতে শত যোজন দূরে। আসলে সৌজন্য জিনিসটাই রাজনৈতিক পরিসর থেকে গুমখুন হয়ে গিয়েছিল। তারই চেহারা দেখেছিলাম “হল্লা বোল” নাটক করতে গিয়ে সফদর হাশমির খুনে। এই বামপন্থী নাট্যকারের হত্যা নির্ঘাৎ রাজনৈতিক হত্যা ছিল। খারাপ লাগে যে ভোটের স্বার্থে এই মৃত্যুকেও ভোলা চলে। পলিটিক্স একই সাথে “সম্ভাবনার শিল্প” আর “লাস্ট রিসর্ট অফ….” না, ওই শব্দটা উচ্চারণ করতে সৌজন্যে বাধছে আমার। বুঝ লোক যে জান সন্ধান।

১৩

আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপুজো এলে শাদা কাগজের উপর লাল কালিতে পূর্ববর্তী বৎসরের হিসেব নিকেশ ছাপিয়ে বাড়ি বয়ে দিয়ে যেত। তখনো মানুষের মনে একটা হিসাব দেবার দায়বদ্ধতা থাকত। পাবলিক মানি নিয়ে নয়ছয় করাটাকে লোকে খারাপ চোখে দেখত। সরস্বতী পূজা হত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও গানের স্কুলে, আঁকার স্কুলে। আস্তে আস্তে রাজনীতি করিয়ে-রা বুঝতে পারলেন জনগণের মধ্যে এই যে সংগঠনী ব্যাপারটা আছে, একে মুঠোয় পোরা চাই। যেখানে যত ক্লাব সংগঠন সব জায়গায় “আমাদের লোক” বসানো হতে থাকল। শিক্ষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, কর্মচারী সংগঠন, সকলের নিজের নিজের ভাষা গেল হারিয়ে। এক অতিলৌকিক নেতৃত্ব সব কিছুকে পকেটে পুরে নিল। এই সব চলতে চলতে একদিন সিনিয়র পুলিশ অফিসার বিনোদ মেহতা খুন হয়ে গেলেন। বিনোদের খুনটি নিশ্চিত ভাবেই রাজনৈতিক খুন ছিল।

১৪

আমাদের স্কুলের প্রতিটি জাঁদরেল শিক্ষকের প্রাইভেট টিউশনি ব্যবসা ছিল। বঙ্গে স্কুল শিক্ষকের পক্ষে প্রাইভেট টিউশনি এক মজার কল। সরকারি হাসপাতালের কোনো কোনো ডাক্তার যেমন পেশেন্ট পার্টিকে ভয় দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন, তেমনি স্কুল শিক্ষকেরাও ছাত্রের আর অভিভাবকের হৃৎকম্প জাগিয়ে নিজেদের খোঁয়াড়ে ভর্তি করতেন। সকালে দু ক্ষেপ আর সন্ধ্যায় দু তিন ক্ষেপ মেরে ওঁরা এমনিই ক্লান্ত থাকতেন যে ক্লাশে পাঠদানে উৎসাহ পেতেন না। যারা কোচিং এ পড়ত, তারা সেখানে বুঝে নেবে বলে ক্লাসে মন দিত না। মাস্টার ক্লান্ত থাকতেন। আমরা যারা কোনো কোচিং এর ধারপাশ মাড়াতাম না, অথচ গবেট প্রতিম, তারা পড়তাম বেকায়দায়। আমরা কোচিং এ ঢুকি নি বলে অনেক মাস্টারের বিরাগভাজন ছিলাম।

১৫

বাবার বক্তব্য ছিল যে স্কুলে দেওয়া হয়েছে পড়ার জন্য। সেখানেই পড়া বোঝার কথা। ছেলেকে সেখানেই বুঝে নিতে হবে। আবার কোচিং কেন?
আর মাস্টাররা ক্লাসে একটা কৃত্রিম অভাব তৈরী করে কোচিং ক্লাসের চাহিদা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে আমার মতো নিরেট গোছের ছাত্রদের কিছু অসুবিধা হত। স্কুলে যাওয়া আসা হত, কিন্তু শেখা কিছু হত না। আমরা পড়া না পারলে শিক্ষক ঘরের বাইরে নিল ডাউন করিয়ে রাখতে লজ্জা পেতেন না। ছাত্র শিখতে না পারলে, না বোঝাতে পারার দায়টা যে শিক্ষকের উপর বর্তায় এই বোধটা ওঁদের ছিল না। ইচ্ছামত প্রহার, বাক্যবাণ এবং নিল ডাউন ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে একটা শাসক ও শাসিতের ভেদ এনে দিত। রামকৃষ্ণ মিশনে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের চিন্তা পদ্ধতি ছিল ব্রাত্য।
১৬
আমার যে লেখাপড়া বিশেষ হবে না, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এ নিয়ে সকলের খুব মাথাব্যথা ছিল। অনেক সহপাঠীর মা তো আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকতেন। মা খুব উৎকণ্ঠাগ্রস্ত না হলেও তারা নানা ভাবে মাকে ব্যতিব্যস্ত করে দিতেন। আমি ছিলাম নির্বিকার। বাবাও কিছু ভাবতেন না। মা পড়লেন উভয় সংকটে। কেননা তিনি আর্থিক প্রশ্নে বাবার উপর পুরো মাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন। অনেক যুদ্ধ করে বাবার থেকে আর্থিক অনুদান আদায় করে তিনি যে কোচিং এ গেলেন, সেখানকার শিক্ষক আমার নাম শুনেই বেঁকে বসলেন। এমনই ছিল বাজারে আমার সুনাম। মায়ের চোখের জলের কাছে তিনি দ্রবীভূত হন ও আমাকে মানুষ করার দায় গ্রহণ করেন। সেটা দশম শ্রেণীর মাঝামাঝি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।