• Uncategorized
  • 0

গদ্যে কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

আরশিনগর – ৩

(১৭)
প্রিয় কৃষ্ণেন্দু,
আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো ? শোনো বলি।
মানুষের জীবনে বোধহয় অপমানের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই। অপমানে মানুষ পূর্ণ হয়। কারণ তাতে তার নিজেকে চেনার ব্রত অনেকটাই উদ্‌যাপিত হয়।
আমার অপমানবোধ আমায় সংকল্পে দৃঢ় করে। রাগ ঠিক নয়, দুই চোয়াল-চাপা এক উত্তেজনা আমাকে জবাবী প্রতিশোধে উদ্দীপ্ত করে । তবুও চেতনা — বিষণ্ণ, বিচ্ছিন্ন এক চেতনা, সে যে অপ্রতিরোধ্য!
আয়নায় নিজেকে দেখছি।
চোখের কোণে এত কালি কি ছিল?
খাতায় নিজেকে দেখছি ।
আমি কি এত বানান ভুল করতাম?
রাত্রে বিছানায় শুয়েও . . .
কারো জন্যে এইভাবে আগে কখনো কেঁদেছি নাকি?
(১৮)
জানি না কীভাবে আমার মধ্যে লেখার ইচ্ছা, ব্যক্তিগত অনুভবকে খাতা-কলমে রূপ দিতে পারার ইচ্ছা বা ক্ষমতা গড়ে উঠেছিল। যদিও মনের মধ্যে যেসব কথার অনুরণন, তার অনেক কথাই অনুক্ত থেকে যায়, কিছুটা অক্ষমতায়, আর কিছুটা বলার মতো মনের জোর নেই বলে, অথবা হয়তো নিজের মনকে চিরে চিরে বিশ্লেষণ করতে ভয় পাই বলে! কারণ — প্রত্যেকেই জানে সে কতটা শয়তান!
তবু লিখি। লিখে তৃপ্তি পাই বলে, মুক্তি পাই বলে। তোমার উদ্দেশে এই যে আমার কথার ঝর্ণাধারা, এও নিজেকে চেনার একটা উপায়। আমি যে সম্পূর্ণ করে চিনতে চাই নিজেকে। অনুভব করতে চাই নিজের পরিপূর্ণ শক্তি। আরশিনগর ঘরের কাছেই, তবু তার পড়শীকে কেন দেখি না ? কেন চিনি না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কেটে যায় সারাটা জীবন। যায় যাক, তবু এই আলো আর অন্ধকারের স্রোতে আমি যুগ্মভাবে অভিযোজিত হয়ে বেঁচে উঠতে চাই; উঁহু, জীবজন্তু নয়, মানুষ হয়ে।
(১৯)
আজ খলিল জিব্রানের ‘The Prophet’ শেষ করলাম, জানো? অসাধারণ একটা অনুভূতিতে এখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছি। সত্যি, পৃথিবীতে ভালো বই পড়ার চেয়ে বেশী আনন্দ আর কিছুতেই নেই। জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠতম তৃপ্তিদায়ক উপায় বোধহয় এইই । চিন্তা-ভাবনা-অনুভূতির সার্থক খাদ্যগ্রহণ।
বইটা পড়ে শুধু একটা কী যেন অতৃপ্তি আমার মধ্যে কাজ করছে। আমি জানি, এ আর কিছুই নয়, এ আমার সৃষ্টির উৎসধারা। কী যেন খুঁজি, পেতে চাই। আর প্রত্যেক চাওয়া যখন এইভাবে না-পাওয়ায় পর্যবসিত হয়, তখনই আমার সেই হাহাকার আমায় দিয়ে করিয়ে নেয় কিছু কাজ — লেখা, আঁকা বা সুর, এমন যাহোক কিছু, যাতে আমি তৃপ্ত হই, মুগ্ধ হই, শুদ্ধ হই। আমার মধ্যে সেই বিরাট শক্তির প্রকাশ ঘটতে দেখে বারবার শুধু কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয় মন — ঋণী, চিরতরে ঋণী, তোমার পেয়েছি আনন্দস্বরূপিনী।
(২০)
খ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায় ?”
(২১)
আচ্ছা, বিমলেন্দুদার কথা তোমার মনে আছে কৃষ্ণেন্দু? বিমলেন্দু চৌধুরী? সেই যে বর্তমান-এর রিপোর্টার ছিল? যার সঙ্গে প্রথমে তোমার দেখাই হয়নি, শুধু দিনের পর দিন চিঠিতেই ভাব-বিনিময় ঘটতো তোমার? অনেকটা এখনকার ভার্চুয়াল জগতের মতো! আর সেই প্রথম মুখোমুখি দেখা হওয়ার অবিমিশ্র আনন্দের মুহূর্তগুলো?
সেদিনের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না, জানো? বাড়ি থেকে বহুদূরে শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে রাত এগারোটা পর্যন্ত দুশ্চিন্তাহীন বসে সেদিনের অনর্গল কথা, আড্ডা আর কবিতা পড়া . . . যেন বাড়ি ফেরার কোন তাড়াই নেই . . . অথবা বলা যায় সেই মুহূর্তে নিজেকে এক যাযাবরের মতো ভাবা, এই অলীক আনন্দ তুমি কার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারো কৃষ্ণেন্দু? বুকে হাত দিয়ে বলো তো, সেদিন কি তোমার ক্ষণেকের জন্যেও সুনীল-শক্তির জীবনযাপনের কথা মনে পড়েনি? নিজেকে মিলিয়ে নিতে চাওনি সেই স্বপ্নের বোহেমিয়ানার সঙ্গে?
সেই বিমলেন্দুদা কিভাবে নেই হয়ে গেল বলো তো? এক হঠাৎ-অসুখের কবলে পড়ে তাকে চলে যেতে হল অসম্পূর্ণ অনেক কাজ ফেলে রেখে। বহু কবিতা, বহু গান, বহু অলীক মুহূর্ত উপহার দিয়ে সে চলে গেল তোমাকে-আমাকে ত্যাগ করে। আজ মনে পড়ে তার এক অদ্ভুত কাজের কথা, যেটা এখনও পর্যন্ত শুধু একজন ছাড়া কেউ করেছে বলে শুনিনি।
বাঙালী জীবনের সব থেকে শুভ অনুষ্ঠান বিবাহ। সেই বিয়েও বাঙালীরা করে কিন্তু সংস্কৃত ভাষায়। বিমলেন্দুদা সেই বিয়ের মন্ত্র লিখতে শুরু করেছিল বাংলায়। ইউনিক আইডিয়া না? সে বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের পরের প্রজন্ম তাদের শুভলগ্নে উচ্চারণ করতো —
“এই নাও আমার হৃদয়
দাও তুমি তোমার হৃদয়।”
(২২)
অনেকদিন পরে আজ আবার বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলাম। সারাদিন কাজ করেছি, তবু কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে মন বড়ো উদাসী হয়ে পড়েছে। বারবার রোমন্থন। স্মৃতির পর্দাটা বারবার ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে গেছে, আর এক স্বপ্নের পার থেকে ভেসে এসেছে কোন এক মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি — যেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ফুলবেলপাতা মেশানো মেদুর গন্ধটাও আমাকে বিহ্বল করেছে — আমি উদ্বেলিত হয়েছি, আর মনে মনে বলেছি, আমায় নিরাশ কোরো না, আমার বর্ণময় কষ্টটার স্বরূপ উপলব্ধি করতে দাও। সেও তো পাওয়া, অনেক বড়ো পাওয়া।
‘পৃথিবীতে আমার তো সবচেয়ে বড়ো কাজ এই যে, আমি তোমায় খুঁজে বের করেছি।’
হ্যাঁ, আমার পরমা রমণীটিকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে প্রেম করতে যাওয়ার সেই স্মৃতিই আজ এই নিঃঝুম রাতে আমার সঙ্গী হয়েছে। বলো তো, তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা জানাবো এইসব কথা, এইসব নিরালা বেদনা?
তুমি কি সেই অভিজ্ঞতা পেয়েছো? কোন মধুর স্মৃতিকে মর্মে লালন করার অপূর্ব আস্বাদ? যে আস্বাদ পেলে মানুষ পূর্ণ হয়, যে শক্তির সান্নিধ্যে মানুষ পৃথিবীর যে কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে দ্বিধা করে না? আত্মস্থ সেই শক্তির সন্ধান তুমি পেয়েছো কি? আমি পেয়েছি। আমার আনাচে-কানাচে আজ সেই যুগান্তের আনাগোনা। আমার সৃষ্টির পথে, আমার ব্যপ্তির পথে আজ সেই পরমা শক্তির প্রলেপন, যার বরাভয়ে ভেসে আসে সমুদ্রগর্জন, যার উপস্থিতিতে শোনা যায় অনন্তের শঙ্খধ্বনি, যার সুবাসে পাওয়া যায় পারিজাতের ঘ্রাণ। আমি তৃপ্ত, আমি মুগ্ধ, আমি পূর্ণ।
(২৩)
জানো কৃষ্ণেন্দু, আমার মা কথাটা প্রায়ই বলেন, ‘মানুষ ঠেক খেতে খেতে, ঠেক খেতে খেতে তবে একটা জায়গায় দাঁড়ায় ।’ ভেবে দেখলে কথাটা কি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই খাটে না ? তুমি যখন এগিয়ে যেতে চাও, তখন তোমার বেঁচে থাকা, পড়াশোনা, জীবিকা, জয়-পরাজয়, ভালবাসা, রোগ, শোক, সমস্ত ব্যাপারে স্তরের পর স্তর ডিঙিয়ে যেতে যেতে স্থৈর্যের পর্যায় আসে। আবার বিপরীতে — মানুষ পিছিয়ে যেতে যেতেও একটা সময় আসে, যখন রুখে দাঁড়ানো ছাড়া করার কিছু থাকে না।
এইসব টুকরো-টাকরা কথাগুলো আমাকে বড়ো বেশী ভাবায়, জানো? অথচ আমি তো ব্রতদার মতো সামান্য কথা থেকে বড়োমাপের নির্যাস খুঁটে নিতে পারি না। এই তো সেদিন কথায় কথায় কি চমৎকার বললো ব্রতদা — ‘নরম মাটি পেলেই লোকে এগিয়ে আসে, মিশতে চায়। ভাবে, এই নরম মাটিতে বীজ লাগিয়ে নিজের দু-চারটে গাছ গড়ে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
ভাবি, আমি কি এমনই এক নরম মাটি? তা নাহলে কি করে এত উত্তাপহীনতা আসে আমার আচার-ব্যবহারে; লোকের রূঢ়তা সত্ত্বেও? কি করেই বা অজান্তে অন্যের শিকড় এসে চারিয়ে যায় আমার মর্মভূমির তলায় তলায়? নাকি, এও আমার সেই ঠেক খাওয়ার পর্যায়, কিছু হয়ে ওঠার জন্যে?
(২৪)
“আজ গৌরীশঙ্করের শিখরে শিখরে
জমে কালো মেঘ
বৈশাখী পাখির ডানা ছড়ায় উদ্বেগ।
তবু এই আকাশসমুদ্র থেকে কাল
লাফ দেবে একমুঠো হীরের সকাল . . .”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।