• Uncategorized
  • 0

গদ্যে অম্লান রায় চৌধূরী

মানুষ – প্রতিষ্ঠান – একার লড়াই 

বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যখন সমাজের উলটো স্রোতে গিয়ে কিছু কথা বলা ও তার যাথ্যার্থতা   প্রমান করার চেষ্টা করা হয় —  তাই একটু বিড়ম্বনা ।
বেশ কিছু শিল্পকর্ম  — যেমন গোপাল কৃষ্ণনের ফিল্ম ফেষ্টিভালে দেখা দুটি ছবি — ১) পিন্নেইয়াম  ২) ওয়ানস  এগেন , দেখার পরে ওই একা একা ভাবটা কেমন যেন পেয়ে বসল – অথচ সবাইকে বলাও যাচ্ছেনা – এই নানা জোট বাঁধার যুগে একা থাকার কথা বলা মানে আত্মহত্যার সামিল ।  এটা জেনেও ঠিক চুপ থাকতে পারছিনা – মনে হচ্ছে কিছু একটা বলার মতন জায়গা বোধ হয় এখনকার সমাজ তৈরী করেছে – যার থেকে কিছু কথা বোধ হয় বলা যায় – তাই এই অবতারনা । হ্যাঁ অবশ্যই ওই ছবি দুটির সাহায্য নিয়েই কিছু বলতে হবে ।
এই ছবি দুটিকে ছাড়া উপরোক্ত বিষয়ের উপর আলোচনা করার জায়গাটা নেই , অনেকটাই নাটকের আঙ্গিক বোঝাতে যেমন প্রপকে ব্যবহার করা হয় , ও দুটোও তেমনই – কাজেই ওদেরকে বাদ দিয়ে  আলোচনায় যাওয়া টা বোধ হয় ঠিক হবেনা।
ছবিগুলোকে এমন ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে যেটা আজকের এই সমাজকে যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ব্যাক্তির ব্যাক্তিসত্ত্বাকে জাগিয়ে দিচ্ছে – সমাজের চিরকালীন ভাবনাকে প্রশ্ন করছে -মন এমন এক জায়গায় যেখানে ব্যাক্তি যেন নিরুপায় এই চলমান সমাজের কাছে । এটা মোটামুটি ভাবার্থ – ছবি দুটির ।
এখনকার পরিস্থিতিতে বোধ হয় বেশ সাবলীল ভাবেই বলা যায় যে আমাদের এই দীর্ঘ পরাধীনতা আমাদের আত্মপরিচয়টাকে একেবারে ঘেটে দিয়েছে । স্বাধীনতার জন্য সমষ্টির জাগরনটাকেই প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা সেভাবে ব্যক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারিনি । ফলে স্বাধীনতার পরেও নিজেদের নাগরিক বলে দাবী করলেও সেই নাগরিক মনটাকে ঠিক মতন ধরতে পারিনি – আসলে মনটা তৈরীই হয়নি। আমরা ক্রমশঃ আরো বেশী অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ব্যক্তিকে দেখতে কোনো না কোনো সামাজিক গোষ্ঠির অভ্যন্তরে । হয়ত নানান লড়াইতে  অথবা  নানান অন্দোলনের মাঝে  – গোষ্ঠি হিসাবে, ব্যক্তি হিসাবে নয় । আমাদের সামনে সেই চরিত্রগুলো এমন একটা রুপ নিয়ে আসে যেটাকে আমরা একটা গড় চরিত্রের হিসাবে পাই । আশ্চর্য এইটাই যে এই মানুষ গুলোর ব্যক্তিগত কোনো সংকট বা বিপন্নতা তাকে কোন ভাবেই ব্যক্তিগত ভাবে বিপন্ন করেনা , ফলে সেই বিপন্নতায়– বেদনায়– বিষাদে যে সে একজন স্বতন্ত্র মানুষ সেটা উপলব্ধই হয়না । ব্যক্তি মানুষ ব্যাক্তিগত ভাবে বাঁচতে চায় , নিজের লড়াইটা নিজেই লড়তে চায় । আমরা বিপন্ন বোধ করলেই চেনা বৃত্তের সাহায্য নিয়ে স্বস্তি বোধ করি । এটাকে সামাজিক নিয়ম কানুনের মধ্যেই মেনে নিয়েছি । এই সমাজ মূখাপেক্ষী ধরনধারন– এই রীতিনীতি নিয়েই পরিচালক প্রশ্ন তুলেছেন তারই ছায়া আমরা দেখতে পাই ওনার ছবি দুটিতে ।
মনে হচ্ছে এটা একটা সমাজ অস্বীকৃত বেঁচে থাকার এক নতুন সংজ্ঞা যেন পাওয়া গেলো ওনার ছবিতে । বিষয় টা নিঃসন্দেহে ভাববার আছে । শুধু আমাদের নয় , যেমন সমাজ ভাববে তেমনি ভাববে গোষ্ঠী প্রধানরা যারা শুধু মানুষ চায় , সংখ্যা চায় , বৈতরনী পার করতে ।
হ্যাঁ মানছি এটা সত্যিই ছায়াছবির মূল স্রোতের দিকে হাঁটা নয়  আর সেই জন্যই এই হাঁটাটাকে একটু অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে । বেশ কিছু প্রশ্ন আসে মনে –  মনে হয় এই একলা চলোরে’র  স্লোগানটা কি সত্যিই সমাজ   বিরোধী কোনো ভাবনা না কি সমাজের সকলের কাছে একটা শিক্ষা । কারন একলা চলতে গেলে বা একলা সমস্ত দায়িত্ত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার ভাবনাটা কি সমাজকে কোন অংশে অস্বীকার করছে নাতো । অন্তত ছবিটি তাই বলতে চাইছে । নিজেকে জাগতে বলছে । বলছে নিজের পরিসর টা তুমি নিজেই বুঝে নাও । আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টা বেশ   বৈপ্লবিক বলে মনে হলেও  যদি আর একটু ভাবি আজকের প্রেক্ষিতে  – বেশ দেখা যায় , পাশের ফ্ল্যাটের ঘোষ বাবুর মৃত্যু সংবাদ পেতে হয় কেয়ার টেকারের ফোনের মারফত।। ঘোষ বাবু বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ  – সেটাও জানা নেই কারুর। এটা বাস্তব । প্রায়শই হচ্ছে এবং এই বিষয় নিয়ে কেউই ভাবছেনা । আমরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছি  এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে চাই সমাজকে বাদ দিয়ে যে  রাস্তায় কোনো বাচ্চা হঠাত পরে গিয়ে আঘাত লাগলে চিকিতসা করাতে ভয় পাই – ওর বাবা বা মা কি বলবে এই আশঙ্কায় । এটা বাস্তব । আবার এটাও বাস্তব যে মানুষগুলোর আজকের এই অবস্থাটা কি সত্যিই  ঐ ছবির  হিসাবে একলা  চলার অঙ্গীকার বা সেই চলোরে’ র স্লোগানেরই প্রতিচ্ছবি নাকি মানুষ ভীষন দিশাহীন – নতুন সমাজিক  সম্পর্কে – কারন সম্পর্কগুলো তে আজ সেই রবীন্দ্রনাথের শুভা গল্পের প্রতাপের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়না – দেখা যায় না সেই  আন্তরিকতা – আজকে সেই অবস্থাটা নেই – কাছে আসা মানেই কিছু পাওয়ার দাবী – অথবা  রাজনীতির  শিলমোহর লাগাতে বাধ্য করা , কিংবা নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার।  সেই ‘প্রতাপ’ বা সেই রকম  দলবদ্ধতা  যখন নেই – তখন এই অবস্থাটা একেবারে সামাজিক স্বীকৃতি পেতে খুব একটা সময় লাগার কথা নয় । লেখক বা পরিচালক এক আগামী দেখিয়েছেন – যার আঁচ আমরা এখনই পেতে শুরু করেছি ।
প্রশ্ন  সত্যিই উঠে আসে যে এটা কতটা লেখক বা পরিচালকের ভাবনার অঙ্গ নাকি লেখক বা পরিচালক নিজেদেরই উপলব্ধ  বিষয় । দুটোই হয়ত হবে এই  ক্ষেত্রে । কিন্তু কেন এই ভাবনার উদয় আর কেনই এই ভাবনাকে উসকানি দেওয়া হয়েছে ছবি দুটিকে – আসলে পরিচালকের উদ্দেশ্য কি , সমাজ থাকবে , সামাজিকতা থাকবেনা , স্বনির্ভরশীলতার প্রয়োজন তো সব সময়ই , তার মানে সমাজের যে যৌথ ভাবনাগুলো সেগুলর কি হবে – নাকি ধীরে ধিরে উঠে যাচ্ছে বলেই পরিচালকের  ভাবনারই প্রতিফলন হচ্ছে বলে আমরাই – কিছুটা ধাতস্থ বা ছবির বিষয় নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় । বিষয়টা এতটা সহজ নয় বা এত সহজ ভাবে দেখার কথাও নয় ।
আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলছি , অনুকরন প্রিয় হচ্ছি , সুযোগের পেছনে চলছি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে – এর ফলে সমাজ বলে কিছু থাকছেনা আজকাল , সেকালের সমাজ নাই ই বা ভাবলাম দু দশক আগের সামাজিক অবস্থাটাও এখন দেখিনা – কারন আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলছি । নিজেদের ইচ্ছাটাকে স্বাগত জানাচ্ছি অন্যের ইচ্ছার আঙ্গিকে , পাশের বাড়ীর  গাড়ীটার পছন্দ আমার পছন্দ হচ্ছে , কাজেই কিনতেই হবে —  নিজেকে হারালাম , ভাবলামনা , আমি সত্যিই  কি চাই – দেখা হলোনা আমার চাওয়া কতটা আমার । এটা একটা অবক্ষয় আমাদের নিজেদের , ফলে আমাদের  ভাবনাগুলো আসছেনা – নিজের মতন করে । বড়ই চিন্তার কথা , হয়ত আজকে খানিকটা ইউটোপিয়ান লাগছে কারুর কাছে , কিন্তু বাস্তবটা কিন্তু অন্য কথা বলছে ।
আমরা কি সত্যিই ভাবছি এই ভাবে ?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।