ক্যাফে গপ্পো -তে মানসী রায়
অন্য কোন ওখানে
১
খবরের কাগজে শহরের পাতাটায় চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ একটা খবরে চোখ আটকে গেল সুমনার।খুব ছোট করে বাঁদিকের কলামেনবেরিয়েছে।রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়িরধাক্কায় মা ও শিশুর মৃত্যু।চারব ছরের ছেলেটা আইসক্রিম খাবে বলে মায়ের কাছে বায়না করছিল।অসাবধানে রাস্তা পেরিয়ে আইসক্রিমের দোকানে যাওয়ার সময়েই দুর্ঘটনা।খবর টাপড়ে কিছুক্ষণ থ’ মেরে রইল সুমনা।আবার এমন হল? ইশ, কেন যে সেবার বারতার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করে! খবরের সঙ্গে সময়টা মিলিয়ে নিয়ে দেখল কোনও ভুল নেই।গতকাল ঠিক ওই সময়ে সে-ও বাপ্পাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিল আর বাপ্পাও আইসক্রিমের জন্য ঘ্যানঘ্যান করছিল।আইসক্রিমের দোকান উল্টোদিকের ফুটপাথে আর কাছাকাছিকোনও ট্রাফিক সিগনাল নেই বলে রাস্তাটায় সবসময়েই প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চলাচল করে।সুযোগ বুঝে পেরোনোর সময় সুমনা ভয়ে ভয়ে ছিল – এই বুঝি এক্সিডেন্ট হল! তার এই তুচ্ছ আশঙ্কাও যে অন্যের ওপর সত্যি হয়ে যাবে সে ভাবতে পারেনি।অবশ্য এই ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়।আগেও অনেকবার এমন হয়েছে।প্রথমবার খটকা লেগেছিল বেশকিছু বছর আগে মাকে যখন নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হল।মায়ের কিডনি দুটো প্রায় অকেজো।ডায়ালিসিস আর কড়া কড়া ওষুধের ওপরই যেন হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক করছে।সেবার ক্রিয়েটিনিন আর পটাশিয়াম বেড়ে প্রায়এই যায় সেই যায়অবস্থা।ভাগ্যিস সুমনা তখন মায়ের কাছে সিউড়িতেই ছিল।দাদা-বৌদি বাইরে থাকে। কোনও রকমে এম্বুলেন্সডেকে কাছেই একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করেছিল।রুগী দেখেগম্ভীর মুখে ডাক্তার যতবার মাথা নাড় ছিল ততবার যেন একটা করে হার্টবিট মিস করছিল সুমনা।বাবা কোন ছোটবেলাতেই মারাগেছে।এবার কি মা-ওচলে যাবে? তার গলা ঠেলে কান্না উঠে এসেছিল।দাদা বৌদিকে জানানোর পর রাজীবকে ফোন করেছিল।রাজীব সেবার ছুটি পায়নি বলেতার সঙ্গে সিউড়িতে আসতে পারেনি।সুমনার ফোন পেয়ে অবশ্য পরদিন ভোরের ট্রেনেই চলে এসেছিল।
” কাল সন্ধেবেলা আমাদের অফিসের বিকাশদার মা মারা গেলেন, জানো!” – জুতো খুলতে খুলতে বলেছিলরাজীব, – ” তোমার মায়ের মতোই কিডনিরসমস্যা ছিল।এক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।তারপর কাল সন্ধেবেলায়… বোধহয় তোমার মায়ের বয়সীইহবেন ভদ্রমহিলা।একবার সেখানে না গেলেই নয়, তাই কাল আসতে পারিনি।নইলে রাতের কোনও ট্রেন ধরেইচলে আসতাম।” সুমনা চমকে উঠেছিল।গত সন্ধ্যায় তোসে-ও তার মায়ের মৃত্যু চিন্তা করছিল।তবেকি…! নাহ, এতো হতেই পারে! সুমনা নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল।সারা পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তেই কোনও না কোনও কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে! ভাবনাটাকে তখনকার মতো পাত্তা না দিলেও ভাবনা কিন্তু সুমনার পিছু ছাড়ল না।অফিসের কাজে রাজীবকে একবার দুমাসের জন্য ভুবনেশ্বর যেতে হল।বাপ্পা তখন সবে হয়েছে।যাওয়ার দিন প্লেনে ওঠার পর রাজীব যখন ফোন করল, কেন কে জানে সুমনার মন কু – ডাকল।যদি রাজীবের প্লেনটা কোনও দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে…তাহলে তার আর বাপ্পার কী হবে! সেসাধারণ গৃহবধূ…।সেবার রাজীবের প্লেন ঠিক মতোভুবনেশ্বরে পৌঁছে গেলেও গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ভেঙে পড়েছিলএকই সময়ে কলকাতাবিমানবন্দর থেকে উড়ে যাওয়াপুণে গামী একটি প্লেন!
সুমনা কেঁদে ফেলেছিল।আহারে, যারা ওই প্লেনে ছিল তারাও তোকারও না কারওর প্রিয়জন! সে অনেক চেষ্টা করেছিল ভাবতে যে এতে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও ভূমিকাই নেই…।হয়তো আসলেই নেই, তবুও একটা অজানা অস্বস্তি আর চিনচিনে অপরাধবোধ তার ভিতরে ভিতরে রয়েই গেল।সেদিনই সন্ধেবেলা ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে সুমনা প্রতিজ্ঞা করেছিল সে কখনও কারও মৃত্যু চিন্তা করবে না।সবাই বেঁচে থাক, ভালো থাক! তবে নিজের লোকের জন্য আশঙ্কা না করার প্রতিজ্ঞাকেই বা কবে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে!…সব মৃত্যুর খবর তো কানে আসে না!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমনা।এতদিনে তো সে বুঝেই গেছে মানুষ আসলে অন্যের হয়ে মরে।যে মৃত্যু সে বরণ করে সে মৃত্যু কখনই তার জন্য বরাদ্দ নয়।নাহলে সিউড়ির উমা কাকীমার তো মারা যাওয়ার কথাই ছিলনা, সাধারণ টিউমার অপারেশনের পর যার আর জ্ঞানই ফিরে এলো না।তাদের পড়শি এই নিঃসন্তান কাকিমা তাকেছোটবেলায় খুব কোলে পিঠে করত।তাঁকে সিঁদুর, আলতা পরিয়ে শববাহী গাড়িতে তুলে দিতে দিতে সুমনার খুব অদ্ভুত ভাবে মনে হয়েছিল তার উমা কাকিমার মৃত্যু চিন্তা করা উচিতছিল যেটা সে করেনি।ভেবেছিল ছোট অপারেশন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে।অথচ তার জায়গায় হয়তো অন্যকেউ অন্য কোথাও ঠিক তার মতো অবস্থা থেকেই সুস্থ হয়ে বাড়িফিরে যাচ্ছে যার আসলে মারা যাওয়ার কথা ছিল।
সুমনা আবারও প্রতিজ্ঞা করে, ভেঙে ফেলবে জেনেও…
২
সুমনা মাঠের মাঝখানে আসতেই বৃষ্টিটা জোরে নামল।এতক্ষণ টিপটিপ করে পড়ছিল।এবছরের বর্ষার প্রথম বৃষ্টি।মুহূর্তের মধ্যে চারদিক একেবারে সাদা।ছাতা থাকা, না থাকা সমান।এইমাঠে বাচ্চারা খেলে, একটু বড় ছেলেরা ক্রিকেট প্র্যাকটিস করে, সকালে বয়স্করা হাঁটতে আসে, তাই কয়েকটা শেড করে বসারজায়গাও করা আছে।বৃষ্টিতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তাও একটা শেডকোনও মতে ঠাহর করে দৌড়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল সুমনা।শেডে তিল ধারণের জায়গা নেই।কি কুক্ষণে যে বাজারে গেছিল আজ! যা বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে, জল জমা কেউ আটকাতে পারবেনা! এটা মনে হতেই মনটা তেঁতো হয়েগেল সুমনার।তাদের পাড়ার অঞ্চলে ভীষণ জল জমে, আর রাস্তার লেভেলের চেয়ে তাদের বাড়ির একতলাটা নীচু – তারাও থাকে একতলাতেই – ঘরে পর্যন্ত জল চলে আসে! এছাড়াও, পুরোনো বাড়ি, দেওয়াল চুঁইয়ে জল গড়ায়।দোতলায় বাড়িওয়ালি থাকে।তাকে অনেকবার বলা হয়েছে।সে নিজে কোনও রকম ব্যবস্থাতো নেয়ই নি, সুমনাদেরও কিছু করতে দেবেনা! উলটে নানা ভাবে চেষ্টা করছে যাতে সুমনারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।তারা বংশ পরম্পরায় এই বাড়িটার ভাড়াটে।তার শ্বশুরমশাইয়ের বাবা প্রথমভাড়া নিয়েছিলেন বর্তমান বাড়িওয়ালির দাদা শ্বশুরের কাছ থেকে।তখন দুইপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক ভালোই ছিল।বর্তমান,মালকিন অনিতা আর সুমনাতো প্রায় একই সময়ে বউ হয়ে এসেছিল।প্রথম প্রথম দুজনের বেশ ভাবওছিল।তারপর একে একে অনিতার শ্বশুর, শাশুড়ি মারা গেল।অকালে স্বামীটাও।একা অনিতা পুরো বাড়িটার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসল।খারাপ ব্যবহারের তখন থেকেইসূত্রপাত।অনেক চেষ্টা করেও অনিতার কোনও সন্তান হয়নি।এদিকে সুমনার ছেলে, স্বামী৷ নিয়ে স্বাভাবিক সংসার।তাই কি অনিতা ঈর্ষান্বিত হয়ে…? সুমনা অত আর ভাবতে পারেনা! পাজির পা ঝাড়া ওই মহিলা! গত বর্ষায় যখন তাদের উঠোনটায় জল জমেছিল, সেখানে ইচ্ছে করে মরা টিকটিকি, মরাছুঁচো, উচ্ছিষ্ট খাবার, এমনকি ব্যবহার করা…ইশ…সেটাও ফেলেছিল।সেসবের কিছু কিছু জলের সঙ্গে তাদের ঘরেও ঢুকে গেছিল! ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে সুমনার! আজকাল তো বৃষ্টিও লাগে না, এমনিই ওপর থেকে গায়ে জলঢেলে দেয়, থুতু ফেলে! কাজেই আজ যদি আবার জল জমে এবং আবারও যদি অনিতাওরকম কিছু করে…ওঃ, অনিতার মাথায় কেন যে বাজ পড়েনা!
বৃষ্টিটা একটু কমল কি? মাথায় ওড়না ঢেকেই বেরিয়ে পড়ল সুমনা।
…………………
“দিদি! এই দিদি, শিগগিরি আয়, দেখে যা!” বোনের চিৎকার শুনে তড়িঘড়িসিঁড়ি ভেঙে নেমে এল অনিতা।দুপুরে বোনের বাড়ি এসেছিল।ভেবেছিল বিকেলেই ফিরে যাবে।কিন্তু অত বৃষ্টি দেখে বোন আর যেতে দেয়নি।বোনের ডাকে বসার ঘরে ঢুকে দেখল টিভিতে খবর চলছে আর বিনীতা বিস্ফারিত চোখে স্ক্রিনেরদিকে তাকিয়ে।তাকে দেখে বলল, “খবরটা দ্যাখ! তোদের ভাড়াটে মহিলা, না? বজ্রাঘাতে মৃত্যু।আজ বিকেলেই।ভালো করে দ্যাখ তো! তোদের বাড়ির এলাকার বাসিন্দাই তো বলছে!”
অনিতার পা কাঁপছিল।হ্যাঁ, তাই তো! যার ছবি দেখাচ্ছে, সে সুমনাই!
“ওর বরের নম্বর আছে তোর কাছে? এখনই একবার ফোন কর না!…” বিনীতা বলেই যাচ্ছে।অনিতার বুকের ভিতরে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছিল।সে জানতেও পারলনা সুমনা মরে গিয়ে তাকে অন্তত এবারের মতো বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।