• Uncategorized
  • 0

এক নৃত্য শিল্পীর স্মৃতিচারণে পৌলামী ব্যানার্জী – ১

পেশা আর নেশা দুটোই একই; নৃত্য শিল্প। গুরুমা হিসেবে পেয়েছিলেন মমতাশঙ্করকে। ছোটদের জন্য গড়ে তুলেছেন নৃত্য শিক্ষার একটি স্কুল। ওঁর শিল্পী জীবনের গল্প বলার জন্য এই প্রথম হাতে তুলে নিয়েছেন কলম।
অনেকক্ষন ধরেই ভাবছি কিভাবে যে শুরু করবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। সত্যি বলতে কি প্রত্যহিক জীবনে নিজে কোনোদিনও ডায়েরি লিখেছি কিনা তা মনে পরে না।অথচ নিজের সম্পর্কে বিশেষত আমার নৃত্য নিয়ে অভিজ্ঞতা লেখার মধ্য দিয়ে কিরম যেন এক সাহসিকতার অনুভব হচ্ছে। জাই হোক ছত থেকে আমার ন্রিত্যের শিক্ষা নৃত্যগু্রুগনের বিষয় ও নানারকম অভিজ্ঞতা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।
সেই সময়ে (সালটা সম্ভবত ১৯৮৬-১৯৮৭) সাদা কাল টেলিভিশনে বাংলা দুরদরশনের প্রচলিত মিউজিক এ আমার সাবলিল নৃত্য ভঙ্গিমা দেখে হয়তো আমার বাবা ভেবেছিলেন নৃত্যের প্রতি সহজাত এই আকর্ষণ আমাকে ভবিস্যতে এক নৃত্যশিল্পী হিসাবে প্রথিস্থা করবে।প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার নিজের পরিবারের কেউ নৃত্যের সাথে যুক্ত ছিলেন না।জারতুত দাদা দিদিরা অল্পবিস্তার সঙ্গিতের সাথে যুক্ত ছিলেন।কিন্তু বাবার অদম্য ইচ্ছা উৎসাহের জোড়ে শুরু হয় আমার নৃত্যের প্রশিক্ষন। তখন আমার বয়স কতই বা হবে এই বছর চারেক হয়তো। নৃত্য শিক্ষার প্রাথমিক প্রশিক্ষন শুরু হয় স্বনামধন্য নৃত্য শিল্পী উদয়শঙ্করের কন্যা সৃজনশীল নৃত্যের অন্যতম কারিগর মমতাশঙ্করের (মম মাসির)কাছে।
নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেই হয়, মম মাসীর কাছে সাত আট বছরের সৃজনশীল কোর্সটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র আমার বাবার অদম্য উৎসাহের জোড়ে। সেই সময় কোনা হাওড়া থেকে হাওড়া ব্রিজ অতিক্রম করে গড়িয়াহাট এ “উদয়ন” এ সপ্তাহে দুদিন গিয়ে নৃত্যের তালিম নেওয়াটা খুব সহজসাধ্য ছিলোনা। কিন্তু বিশ্বাস করুন এখন যতটা উৎসাহের সাথে বাবার অদম্য ইচ্ছা শক্তির প্রশংসা করতে পারছি সেই সময় কিন্তু নাচ শিখতে যাওয়ার দিনে সকাল থেকেই আমার ভীষণ মনখারাপ হয়ে যেত। বিকেলে বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি কবাডি খেলা ছেড়ে ওই অতদুরে নাচ শিখতে যেতে কারই বা ভাল লাগতো বলুন তো?
যাই হোক এবার আপনাদেরকে “উদয়ন” এ আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলি। বাড়ি থেকে আমার মা বাবা ভাল ভাবে শিখিয়ে দিয়েছিলেন যেন আমি তাদের সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে পারি এবং নাচ করতে যে খুব ভালো লাগে তা বলি। কিন্তু বলুন তো ছার পাঁচ বছরের একটা বাচ্ছা মেয়ের সত্যি কি অনুধাবন করা সম্ভব যে তার নাচ করতে ভালো লাগে কি না?
তা যথারীতি রবিবার (প্রথমদিনের তারিখটা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না) বিকেল চারটের মধ্যে বাবার সাথে উপস্থিত হলাম “উদয়নে”। গিয়ে দেখলাম অনেকে আমার বয়সি ও আমার থেকে কিছু বড় মেয়েরাও এসেছে। আমরা সবাই সেদিন অফিসঘরে অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষন পরে দুজন কাকু এসে বললেন মমদি এখনি এসে যাবেন। এর খানিক্ষন পরে অফিস ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম গেটের কাছে একটা হলুদ ট্যাক্সি এসে থামল। সঙ্গে সঙ্গে অফিস ঘরের অনান্য কাকুরা গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, কিন্তু গাড়ি থেকে কে নামছেন বুঝতে পারছিলাম না। একটু ভালভাবে দেখার জন্য যেই জানালা দিয়ে মুখটা একটু বাড়িয়েছি সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে একজন আনটি জোড়ে বলে উঠলেন তোমরা কেউ ছটফট করবে না। তিনি আরও বললেন মম মাসী ঘরে ঢোকামাত্রই আমরা যেন সবাই ওনাকে হাত তুলে নমস্কার জানাই। সেই নমস্কার জানানোর রীতি বোধহয় আজও অব্যাহত। কিছুক্ষন পরে ঘরে ঢুকলেন মম মাসী। আমি আপনাদেরকে বলে বোঝাতে পারবোনা প্রথমদিন ওনার মধ্যে যে স্নিগ্ধ্যতা স্নেহের পরশ দেখে ছিলাম তা ওনার প্রতিটা ক্লাসেই অনুভব করেছি। আমরা সবাই ওনাকে নমস্কার জানানোর আগেই উনি হাত তুলে আমাদেরকে নমস্কার জানালেন। ওনার সেই প্রথম দিনের মিষ্টিটোল পড়া হাসির মুখশ্রি আজও ভুলতে পারিনা। এরপর ওনার কথামত আমরা সবাই ক্লাসরুমে এলাম। আমাদেরকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। এরপর কার কি নাম, কোথায় থাকা হয় ইত্যাদি টুকিটাকি পরিচয় পর্ব চলে। তার সঙ্গে শ্বাশতি আন্তি, সুভ্রা আনটি দের কেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। আমি যখন বলি আমি হাওড়া কোনা থেকে আসছি তখন সবাই যেন একটু অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। মম মাসী তো বলেই ফেললেন তুমি অত দূর থেকে আসছ?-হ্যাঁ। তিরিশ বত্রিশ বছর আগে হাওড়া থেকে গড়িয়াহাটের দূরত্বটা বোধহয় একটু বেশিই ছিল, বর্তমানে সেই দুরত্ব অনেকটাই কমে গেছে বিদ্যাসাগর সেতুর দৌলতে।
যাই হোক প্রথমদিনের ক্লাসে গল্প মজাই বেশি হয়েছিল সেইভাবে নাচ শেখা কিছু হয়নি। তবে “ভাইকাকা” তার ঢোলে মাঝে মাঝে ছন্দের সঞ্চার করছিলেন তার সাথে আমরাও একটু আধটু গা হাত পা দোলাচ্ছিলাম। ক্লাস ছুটির পর নাম ডেকে আমাদেরকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে অ্যান্টিরাও অভিভাবকদের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় পর্বটি সেরে নেন। ও বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম প্রথমদিনের ক্লাসে আমাদের সকলকে দুটি করে চকলেট দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েগেল সপ্তাহে দুদিন রবিবার ও বুধবার নাচের তালিম।
জানেন তো জীবনের অভিজ্ঞতা সবসময় ভালখারাপ মিশিয়ে হয় আমিও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবে জীবনের এই বয়সে সেই ছোট ছোট মনখারাপের অভিজ্ঞতা গুলিকে ছেলেমানুষি হিসাবে ভুলে যেতে পারিনা। সুতরাং নৃত্য জীবনের অভিজ্ঞতা লিখতে বসে যদি সেই খারাপ দিক গুলিকে এড়িয়ে যাই তাহলে কোথাও যেন মনে হয় নিজের সাথে মিথ্যাচার করছি। তাই ঠিক করলাম সবটাই আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।