এই সময়ের লেখা শ্রীলেখা চ্যাটার্জি

” পরিযায়ী -সংকট ”

যেতে হবে অনেক দূর | মুম্বাই থেকে বীরভূম , কেরল থেকে মুর্শিদাবাদ , সুরাট থেকে বর্ধমান, চেন্নাই থেকে পুরুলিয়া , দিল্লী থেকে গুজরাট , ব্যাঙ্গালোর, দক্ষিণভারত। সারাদেশে ছড়িয়ে আছে ওরা | ওরা পরিযায়ী শ্রমিক | মাইলের পর মাইল হেঁটে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলেছে |
বন্ধ হল কলকারখানা, বন্ধ হোল যানবাহন ; বন্ধ দোকান পাট , স্কুল কলেজ | চারিদিকে ছড়িয়ে আছে আতঙ্ক আর হতাশা | কে জানে কখন কোথায় সেই অলখিত বিষবাহক এসে কুরে কুরে গ্রাস করে নেয় শরীরটাকে | লকডাউনের নিয়ন্ত্রণে নির্মম পরিহাস | সবাই গৃহবন্দি | কতদিন চলবে — কারো জানা নেই | কী করবে দীন দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষগুলো ? ঘর থেকে বেরিয়েছিল শ্রম বেচে রোজগারের তাগিদে | কাজ শেষে ঘরে ফিরবে পরিবারের প্রয়োজনীয় আবদার মিটিয়ে | স্ত্রী সন্তান আর মায়ের মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখে | মানতে চায় না ভাইরাসের সংক্রমণ , অজানা ব্যাধির কবলে মৃত্যুর ইশারা !
ওরা ঘরে ফেরার ডানাভাঙা পরিযায়ী শ্রমিকদল | ওরা হাঁটছে , হাঁটছে ; গরমে ঘাম ঝরে গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে চলার পথে; রোদের তীব্রতায় শরীর জ্বলছে , পায়ের চটি খসে গিয়েছে, খালি পায়ে চলা শুরু; পা ফুলে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে | রয়ে যায় পথে ঘামে ভেজা অজস্র পায়ের ছাপ ,পথের ধুলোয় মিলেমিশে একাকার | পথের ধুলো হয়েছে বস্ত্র সমান | চোখের কোলে পুরু হয়ে কালি পড়েছে | দম বন্ধ হয়ে আসে ; তবু ও পথ চলা বন্ধ হয় না | আরও অনেক পথ বাকি গন্তব্যে পৌঁছাতে | না ! ওদের জন্যে কোনও শিবিরের ব্যবস্থা হয়নি ; তৃষ্ণায় জল নেই , খিদেতে খাবার নেই ; তবু ওরা এভাবেই পৌঁছে যাবে ওদের ঘরে | আরও কত দিন এভাবেই অভুক্ত, তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কাটাতে হবে , ওদের জানা নেই | পরিবারের কাছে | বিশ্বাস — পৌঁছোবেই |
করোনা কে ওরা ভয় করে না | ওদের মুখে মাস্ক নেই , পরনে মগ্ন ছিন্ন বস্ত্রটুকুই সম্বল | ওরা শুধু বোঝে পেটের জ্বালা ! ক্ষিদের তাগিদ! পিপাসায় সরকারি কলের জল ; কিন্তু খিদেতে ? পেট কি মানবে ? কোথায় পাবে খাদ্য ? কিসে ভরবে পেট? কাছে যেটুকু ছিল শেষ হয়ে গেছে | নিরাপত্তা বিহীন হেঁটে চলা | পেট মুচড়ে খিদের জ্বালা বুঝিয়ে দেয় অতীত আসছে ফিরে | রক্তিম সমারোহে সমাজ বরণ |
বিষ বেঁধা বিধ্বংসী জীবাণুর ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশগুলো ছুটে আসে আগ্রাসনের প্রতিকৃতি হয়ে | বিশ্ব তোলপাড় ; মহামৃত্যুর যজ্ঞ চলছে দিকে দিকে | বাড়তে থাকে বন্দী জীবনের আয়ু | কিন্তু ওরা কি বোঝে লকডাউনের মর্ম ? ওরা শুধু বোঝে পেটের জ্বালা | বৃহৎ- এর মধ্যে ওদের আনাগোনা নয় ; ছোট্ট সংসার , নিজের পরিবারেই সীমাবদ্ধ ওদের চিন্তা ভাবনা , হাসি খুশি আনন্দ |মাথার উপর ছাদ আর খিদের সংস্থান — এটুকুই ওদের কাছে জীবনের উপাখ্যান | ওরা জানে যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে না | কিন্তু মালগাড়ি ? ভাবনায় ছিল না | অন্ধকারে অলক্ষে চলে যায় লাইনে শোয়া শ্রমিক শরীরকে বিচ্ছিন্ন করে | না ! করোনা ওদের নিতে পারেনি | দুর্ভাগ্যের করাল ছায়ায় চলন্ত মালবাহী ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে গেল কয়েকটা জীবন , কিছু স্বপ্ন | ছত্রাকার হয়ে পড়ে থাকল লাইনের উপরে কটা রুটি , প্লাস্টিকে মোড়া বাতাসা , জলের বোতল , কাপড়ের পুঁটলি , গামছা আর কিছু বেদনা ! ফটো তুলে প্রচার কার্যে সহায়তা করল , ট্রেন আসছে – তারও ফটো তুলে – শুরু থেকে শেষ অবধি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সহ ছবি তুলে পোস্ট করলেন তারা কী এইটুকুর জন্যে ই অপেক্ষা করছিলেন? মিডিয়ার হাতে রান্না হবে কিছু রাজনীতির খোরাক , আর আমরা অর্থাৎ জনগণ সমালোচনার লালায় ভিজিয়ে খাবো ? তারা তো অনায়াসেই তাদের বাঁচাতে পারত !
পথের ওপরে এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে অভুক্ত ক্লান্ত শরীর | শরীর জুড়ে উন্মাদনা – কখন পৌঁছবে নিজেদের ভিটেয় ! চোখে মুখে ভীতি আর বিষাদের ছায়া | সঙ্গে আছে শ্রমিক সাথীর পোয়াতি স্ত্রী আর তার বাচ্চা ছেলে | খাঁ খাঁ করছে মাঠ ঘাট,জনবিহীন রাস্তা | শুধু পরিযায়ী শ্রমিকের মিছিল | শুরু হল প্রসব যন্ত্রণা ! রাস্তার ধারে গাছের তলায় হল আঁতুড়ঘর | আর ওরাই নার্স , ওরাই ডাক্তার ! অবশেষে প্রসূতির কোলে জন্ম নিল আগামীর বিপ্লব | ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার শুরু হয় পথ চলা — সদ্যজাত শিশুকে বুকে আঁকড়ে ধরে | এমন ভাবেই পেরিয়ে গেছে অনেক পথ ; অতঃপর চালু হল পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্যে নির্দিষ্ট কিছু ট্রেন বাস | চলার পথে পড়ে থাকল কত ক্ষুধার্ত মানুষের লাশ ! মায়ের লাশকে ঘিরে অবুঝ শিশুর খেলা ; কী হবে সেই শিশুর ভবিষ্যৎ ? এক মর্মান্তিক ইতিহাস লিখে দিল এই বিষাক্ত বছর |
এরপর তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছলে শ্রমিকদের করোনা টেস্ট করা হল | তাদের অনেকের শরীরেই ধরা পড়ল করোনা পজিটিভ | কিন্তু কোয়ারেন্টাইনে তারা থাকল না | মানল না লকডাউন ! শুরু করল সন্ত্রাস, অদমনীয় অরাজকতার কবলে পড়তে হল পুলিশ ও দেহরক্ষীদের | না বেরোলে কাজ করবে কী করে ; কাজ না করলে টাকা আসবে কী করে ; টাকা উপার্জন না করলে ক্ষিদের জোগাড় হবে কী করে ! পেট তো শুনবে না !
লক ডাউন একটু শিথিল হয়েছে | সবাই নেমে পড়েছে ময়দানে | চলছে ইদের রমরমা বাজার , খাদ্য রসিক বাঙালির ভুরিভোজের আয়োজন ; সবাই ভুলে গেছে লকডাউনের পরিকাঠামোর কথা | কিন্তু নামকা বাস্তে গৃহবন্দি অবস্থা এখনও চলছে , চলবে | মানুষ হয়ে উঠেছে আয়াসি , কষ্ট করতে ভুলে গেছে , ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছে | বাঁচার অর্থ মনে করে ভালো মন্দ চারবেলা ভুরিভোজ, কোনো না কোনও কারণে বাইরে ঘুরতে বেরোনো ; বাঁচার জন্যে লড়াই করার অর্থ মনে করে কিছু শ্লোগান , কিছু খুন-জখম, রক্তপাত , ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি | সবাই যখন আমপানের অত্যাচারে বিধ্বস্ত , পরিবেশ পরিস্থিতির অচলাবস্থায় হিমসিম খাচ্ছে , জীবন যাপনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে , সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থা বেদনা দায়ক হয়ে উঠেছে , ইলেকট্রিক অফিসের কর্মচারীরা তখন মোটা টাকার অংক কষছে | জনসাধারণকে ব্ল্যাকমেল করছে |
কী হবে ? এই মানুষগুলোর ! এরপরে মানুষ পেটের দায়ে হন্যে হয়ে যাবে | মার্কেট উত্তুঙ্গে | মৃত্যুকে এড়াবার জন্যে যে সীমাবদ্ধতার সূত্র নিবন্ধ হল , সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জন্যে তা সহজলভ্য নয় | ক্রমশঃ আকাশছোঁয়া দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি জীবন যাত্রাকে বিষাদময় করে তুলেছে | কর্ম মুখর সমাজ সংসারে কাজ থাকবে না ; বেকার সমস্যা আরো প্রকট হবে | বেকারত্বের জ্বালায় ঘরে ঘরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে | কাজ নেই — অন্ন নেই ! নিরন্ন মানুষের চোখে মুখে সন্ত্রাসের ছায়া নেমে আসে ; খেটে খাওয়া মানুষ তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে গর্জে উঠবে | করোনার আক্রমণ বেড়ে যাবে ক্রমশঃ | মৃত্যু পৌঁছে যাবে দোরগোড়ায় | এর উপর ‘ আমপানের ‘ তাণ্ডবে চারিদিক বিধ্বস্ত ! বিদ্যুৎ নেই , জল নেই, মোবাইলের কানেকশন নেই টাওয়ার গুলো ভেঙে চূরে তছনছ হয়েছে , টিভির কানেকশন নেই, খবর নেই ! কেউ কারুর খোঁজ নিতে পারছে না | শুধু সর্বত্র অন্ধকারের স্তব্ধতা |
তবে কি আবার শুরু হবে সংঘাত ? শ্রেণী সংঘর্ষের উত্তপ্ত হাওয়ায় কলকাতার মনুমেন্ট – ময়দান লাল হয়ে উঠবে ? হাজার হাজার শ্রমিক কিষাণ মজদুরের শ্লোগানে সমাজ রাষ্ট্রনীতি কেঁপে উঠবে ? শিক্ষার আড়ালে থাকা মানুষগুলো তুলে নেবে যুদ্ধের হাতিয়ার ; বাঁচার লড়াই , অধিকারের লড়াই ! আগুন ওড়াবে , কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হবে আকাশ , বাতাসে বইবে বিষ !
বাজার থেকে উধাও হয়ে যাবে কাঁচামাল, খাদ্য দ্রব্য, বেবি ফুড, ইত্যাদি | হাহাকার করবে মানুষ | তৈরি হবে আর একটা দুর্ভিক্ষ | আবারও জীর্ণ কঙ্কালসার শরীরের মিছিল চলবে | আবারও দুয়ারে দাঁড়িয়ে শীর্ণকায়, দুটো সরু সরু হাড়ের উপর চামড়া বসানো হাতে ফাটা তুবড়োনো স্টিলের থালা ধরে ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বলতে থাকবে ” ফ্যান দাও মা ফ্যান ” ! বন জঙ্গল , পুকুর ডোবা , নালা নর্দমা সব যেন নেড়া হয়ে যাবে | যেন ঝাড়ুদার পাখির ডুপ্লিকেশন ঠিক যেমন শ্রমিকের প্রতীক হয়েছে পরিযায়ী |
লাগবে মড়ক ! গর্তে ঢুকে যাবে চোখ ; রাস্তায় ঘাটে বনে বাদাড়ে পড়ে থাকবে লাশ | সৎকারের কেউ থাকবে না |
প্রতিবাদী কণ্ঠে আবার উচ্চারিত হবে ” দুনিয়ার মজদুর এক হও ” ! , ” বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ” ! , ” আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে ” ! আবার ফিরে আসবে ১৯৭০/৭১ সাল ! ইনক্লাব ধ্বনিতে আকাশ ভেঙে পড়বে ! জেগে উঠবে শ্রমিক, কৃষক থেকে আপামর খেটে খাওয়া মানুষের ঘুমন্ত চোখ | আবার জন্ম নেবে ঘরে ঘরে তীরন্দাজ জঙ্গল সাঁওতাল | আজ যারা দয়ার পাত্র কাল তাদের দয়ার অপেক্ষা করতে হবে ; আজ যাদের ঘুম কেড়ে নেওয়া হল সেদিন তারাই হয়তো সকলের ঘুম কেড়ে নেবে | আলো থাকলেও অন্ধকারকে বেছে নিতে হবে | লকডাউন না থাকতে ও সবাইকে হতে হবে ঘরবন্দি | সমাজ রাষ্ট্রনীতি, তোলপাড় করে শ্রেণী সংঘর্ষের উত্তপ্ত হাওয়ায় স্তব্ধ হবে মানুষের জীবনযাত্রা |
মানুষের বিশ্বাস ভরসা সব কিছু লেখা হবে রক্ত দিয়ে ??
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।