• Uncategorized
  • 0

উৎসব সংখ্যায় রম্যরচনা – সুনীল বরণ কালিন্দী

কাটমানি

– একি! এ যে মেঘ না চাইতেই জল! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না!
সূর্য কি আজ পশ্চিমে উঠেছে? স্বয়ং মহাদেব মর্ত্যলোকে! দেবতারাও তাহলে আজকাল চমকাচ্ছে!
-ভগবান ভক্তদের কাছে আসবে এতো স্বাভাবিক ব্যাপার|
– বেড়ে বলেছেন মাইরি| তা এতোদিন “তুমি কোথায় ছিলে ওস্তাদ, তুমি কোথায় ছিলে?” যখন শিয়ালের গুয়ের দরকার পড়ে , শিয়াল তখন পব্বতে হাগে| ডেকে-ডেকে শালা গলার ভোকাল কর্ড ছিড়ে গেল, গলগণ্ড বাঁধিয়ে নিলুম, তবুও টিকির দর্শনটি মেলেনি| আর আজ না ডাকতেই…………নিজের বুদ্ধিতে নিশ্চয় নয়!মনে হয় কারো পরামর্শে এসেছেন| শুনলাম নতুন পরামর্শ দাতা নিয়োগ করেছেন?
-ভক্তের সুখ-সুবিধা দেখাই তো দেবতাদের কর্তব্য| এজন্য কারো পরামর্শ নিতে হবে না কি?
-আহা-হা! দরদ একেবারে উথলে উঠছে গো|কী নরম বাক্যালাপ! নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না| কোথায় গেল সেই ব্রহ্মতেজ?
-তোরা দেবতাদের বিভিন্ন প্রকল্পের সুফল ঠিকমতো পাচ্ছিস কি না, সঠিক সময়ে মনস্কামনা পূরণ হচ্ছে কি না, প্রয়োজন মতো বর পাচ্ছিস কি না, নাহ্যমূলে মানত করতে পারছিস কি না, সব দেখার জন্যই তো আসা| নে-নে অনেক হয়েছে তোকে একটু চা বানিয়ে খাওয়াই|
-আপনার মতো ঘাগু মাল বিনা উদ্দেশ্যে ভক্তের দরবারে বসে চা বানাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না| নিশ্চয়ই এই চায়ে পে চর্চার পিছনে কোনো গোপন রহস্য আছে| কোনো মতলব আছে| ইতিহাস সাক্ষী আছে দেবতারা সব নিজের ধান্দায় ঘোরে| নিজেদের স্বার্থে মানুষকে ব্যবহার করে| স্বার্থ ফুরুলেই ফুড়ুৎ| মর্ত্যধামে নিজেদের পুজোর প্রচারের জন্য মানুষ কে বলির পাঁঠা করে| আপনারা হলেন গিয়ে Summer bird.
-আমার সব কিছুতেই তোদের জ্বলন| কিছু একটা বললেই হামলে পড়িস| আরে কাজ যে করে ভুল তারই হয়|
– হ্যাঁ হ্যাঁ ঐতিহাসিক ভুল|
-শুনেছি তোর নাকি অনেক বুদ্ধি| মাতাল হলেও জ্ঞান-গম্যি কম নয়| শুনলাম আবার একসঙ্গে এম. এ., বি.এড, এল.এল.বি করেছিস| তুই ই বল ভক্তদের ক্ষোভের কারণ কি?
– এটা জানার জন্য ‘দেবতাদের বলো’ বলে একটা ফোন লাইন চালু করলেই তো পারতেন|
-মন কি বাত ফোনে-ফোনে হয় না বচা| সামনা-সামনিই ভাল| তুই ই বল|
-ফোকটে পরামর্শ মেরে নিবেন| এর চেয়ে আমাকেই পরামর্শ দাতা নিয়োগ করতে পারতেন| খরচাটা বেঁচে যেত| শুধু Every time মদ অন করে রাখলেই হত| আর মরে গেলে বউটাকে দু’লাখ দিলেই হত|
– নে বাবা আর ট্রোল না করে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দে তো শুনি।
-বলুন|
-পুজোর আর কয়েকটা দিন বাকি| অথচ আসার পথে কোনো আয়োজন লক্ষ্য করলাম না| অনেকেই দেখলাম খুঁটি পুজোটাও করে নি| মর্ত্যবাসী কি সব উদারপন্থী হয়ে পড়ল? দেব-দ্বিজে ভক্তি উড়ে গেল? কুসংস্কার সব উড়ে গেল? কেবল বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা|
-বন থেকে পশু তুলে আনা যায় কিন্তু পশুর মন থেকে কখনো বন তুলে ফেলা যায় না| কুসংস্কার ছিল, আছে ,থাকবে অন্তত যতদিন মানুষ এই পৃথিবীতে বাস করবে| আরে বাবা বারবেলার ফোক্করে পড়ে চন্দ্রযান যাত্রা পর্যন্ত বাতিল হয়ে গিয়েছিল|
-তাহলে এবার পুজোতে মানুষের এতো অনীহা কেন?
-দুর্গা পুজাে বছর-বছর করতে কেও কি মাথার দিব্যি দিয়েছে?  শহরের হেভিওয়েট ক্লাব গুলো সব অন্য পুজােয়  নাম লেখাতে দিল্লি চলো ডাক দিয়েছে| লাইনে আরো হেভিওয়েট আছে|
-এটা কিছুতেই মানা যায় না| আমি সব দেবতাদের জড়ো করে ফেডারেল ফ্রন্ট গঠন করে আন্দোলন করব|দরকার হলে জেলে যাব| তবুও মর্ত্যে অন্য দেবতার পুজো হতে দেব না|জেলে গেলে ভাবব অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে লড়ছি| লোভ দেখিয়ে আমাদের পুজোয় ভাঙন ধরানো যাবে না| চমকানোর বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে এসেছে তাদের চমকানো যায় না| আমাকে বাগে আনা যাবে না| স্বার্থপর সব| কি করিনি ওদের জন্যে! লাখ লাখ টাকা জলের মতন খরচ করেছি| গেল বছর থেকে পুজোতে দশহাজার করে বোনাস দেওয়া শুরু করেছি| এবছর বোনাস বাড়িয়ে পঁচিশ করেছি| এতো কিছু পেয়েও…………..
-এক লাফে পঁচিশ! তাহলে নাই নাই করে সেদিন কাঁদুনি গাইছিলেন যে| টাকা কি এখন তবে গাছে ফলছে? না, রিজার্ভ ব্যাঙ্কটা নিজের সম্পত্তি করে নিয়েছেন? তার মানে আছে, কিন্তু দিবেন না| তাই তো? এসব দেখে ভুল তো সবাই বুঝবে|
-নেমকহারামের দল সব| অকর্মার ধাড়ি|
উয়ারা সব অনুদান নেয় বাটি বাটি
রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি
ঘোট পরবে দিল তো দান উল্টি
মর্ত্যে মোর একি অনাসৃষ্টি!
-একা দেবতায় রক্ষে নেই পুরোহিত সরি  চামচারা আবার দোসর!
-আবার ওদের নিয়ে টানাটানি কেন?
-ওরাই তো যতো নষ্টের মূলে| বাস্তুঘুঘু সব এক একটা| তোলা আদায় করছে| সরস্বতীর নামে, লক্ষীর নামে, গনেশের নামে, কার্তিকের নামে| জোর জুলুম চলছে| হাতে ফর্দ ধরিয়ে হুমকি দিচ্ছে|
-সে কি! কবে থেকে? এ খবরটা তো জানতাম না!
-জানবেন কি করে, আপনি তো আর খবর দেখেন না| খবর তৈরী করেন|
-ওদের কষ্টের কথা ভেবেই তো ভাতা বাড়ালাম|
তবুও……….
-আন্দোলন করবে একজন আর ভাতা বাড়বে অন্যজনের| কি বিচার মাইরি….. তেলা মাথায় তেল দেওয়া তো আপনার চিরকালের অভ্যাস| দরিদ্র্যের ক্ষুধা আর বুঝলেন না|
-কি আল-ফাল বকছিস| দরিদ্র্যের জন্য সস্তায় রেশনের ব্যবস্থা করেছি|
– বিনিময়ে তিল-তিল করে জমিয়ে রাখা টাকা খেয়েছেন| তাও আবার সেই দেবতার নাম নিয়েই| এবার সব কটাকে ফটকে পুরবে| তোতা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে| সাবধান|
-ওদিকে একটা হল্লা হচ্ছে মনে হচ্ছে|
-আপনি এসেছেন খবর পেয়েছে| তাই মন কি বাত সামনা-সামনিই করতে আসছে|
-কি বলছিস! একসঙ্গে এতো লোক সামলাব কি করে? এ বচা ?
–আমার মনে হচ্ছে ওরা সবাই  কাটমানির হিসেব নিতে আসছে|
-এরা আবার কাকে কাটমানি দিল|
-কেন আপনার পুরোহিতগণ, সরি চামচা দের| ওই যে সামনে আসছে ওর নাম ত্যালগা বিশু| ওর বউটা গত একবছর ধরে পুত্রসন্তান লাভের বাসনায় আপনার পুজো দিয়ে আসছে| পুরোহিতের ফর্দের কিছুটি বাকি রাখে নি| তবুও কোল খালি| তাই ও কাটমানি ফেরৎ নিতে আসছে|
– ওরে হাঁদারাম সন্তান লাভের জন্য কাটমানি দিতে হয় না| দেবতাকেও লাগে না| স্বামী-স্ত্রীর পরিপূর্ণ ভালোবাসায় যথেষ্ট| বিশুকে বাইরে রাত কাটাতে নিষেধ কর| একবছরের মধ্যেই খালি কোল পূর্ণ হয়ে যাবে| নইলে এবার পস্তাতে হবে| কে কখন পিছন দিক থেকে গুলি মেরে দেবে|
ভাই বচা?
-বলুন মহাদেব দা|
-পাল-পাল লোক আসছে যে|
-মুখোমুখি কথা বলার সমস্যা দেখছেন| জানতাম সামলাতে পারবেন না|
-কিন্তুু ফোনেও তো এতো লোকের……
-নিকুচি করেছে| ফোনটা কি আপনি ধরবেন?
-তবে?
– আপনার কাছে ফোন যাবার আগে দুটো হার্ডল পেরোতে হবে, ঠিক ভবসাগর পারের মত|
– একটু বুঝিয়ে বল|
– দেবতাকে বলার আগে অসুর কে বল|সেখানে এক প্রস্থ স্ক্রিনিং টেস্ট| মানে ওই প্রিলিমিনারি পরীক্ষার মতন| নানান প্রশ্নে ব্যাতিব্যস্ত করে দিতে হবে| আর মাঝে-মাঝে অসুর দের সেই ট্রেড মার্ক অট্টহাসি দিতে হবে| তাহলেই তিতি বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেবে| যদি কোন ধৈর্যধর  ওই হার্ডলটা পেরোতে সক্ষম হয় তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে হানি ট্রাপ- রম্ভাকে বলুন, উর্বসীকে বলুন| এই ভাবে বলতে বলতে ওরা হেঁদিয়ে উঠবে| অভিযোগ জানানোর ইচ্ছা মরে যাবে| কিন্তু কায়দা করে আপনি ওদের সব ঠিকুজি জেনে নিলেন| এবার সময় সুযোগ মতো ব্ল্যাকমেল করলেই হল|
– তোর তো হেভি বুদ্ধি| তোকে এবছর শিক্ষক দিবসে বুদ্ধিরত্ন দেব| তুই আজই দেবতাদের দলে ভিড়ে যা|
-আজ যোগ দিলে কালকেই রত্ন|
-হ্যাঁ রে|
-না বাবা| এই বেশ ভালো আছি| শেষকালে বিরিয়ানির জন্য কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি করে মরি আর কি| খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হলো তার এঁড়ে গরু কিনে| আমি বরং ফোকটেই পরামর্শ দেবো| আপনি বরং আর একটা কাজ করতে পারেন|
– বল বল সব খুলে বল| আমার আর তর সইছে না|
-আপনার যত চেলা চামুন্ডা আছে তাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দিন| ডোর টু ডোর ভিজিট করুক| এমনকি রাত্রি যাপনও করুক মানুষের গৃহে| দেবতার পেয়েই মানুষ গদগদ হয়ে যাবে| অভাব অভিযোগ ভুলে সেলফি তুলতেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে| আর চেলারা এই সুযোগে মানুষদের নাড়ি-নক্ষত্র জেনে সুযোগ মতো কড়কে দিবেন|  সব ক্লিয়ার|সাপও মরল লাঠিটাও অক্ষত রইল|
– তোর এতো বুদ্ধি! রাত্রে ঘুম হয়?
-একেবারে নাম ডেকে|
ঘড় ঘড় ঘড ঘড়াৎ|
-জ্বালিয়ে দিল মিনসেটা| সারাদিন খাটা-খাটুনি সেরে যে নিশ্চিন্তে ঘুমোবো, তারও জো নেই| অমনি কানের গোড়ায় নাক ডাকা| এই শুনছো?
বচা ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে|
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।