• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় সুব্রত বসু

আমার রবীন্দ্রনাথ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বজনীন।একান্ত ভাবে তিনি আমার হবেন সেই ভাবনার স্পর্ধা আমার নেই। কিন্তু এমনই তাঁর মহিমা তিনি প্রত্যেকের কাছে ধরা দেন স্বতন্ত্র রূপে।ব্যক্তি তাঁকে নিজের মত করে গ্রহণ করে, দখলদারি মানসিকতায় ভাবতে থাকে এ সম্পদ তার নিজের। কিন্তু আশ্চর্য সেই সম্পদ বহুজনের কাছে নানাবর্ণে বিচ্ছুরিত। আমি সেই বহুর একজন, রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে ধরা দিয়েছেন আমারই মতন হয়ে। আমার দুঃখে আনন্দে বেদনায় অপমানে তিনি আমার একান্ত সঙ্গী। জীবনযাত্রা পথে তিনিই সহায়। সেই প্রাপ্তির পরম্পরা নিয়েই অকপট বিশ্লেষণ।
আমার জন্ম হয়েছিল হাওড়ার এক ঘিঞ্জি এলাকায়। কংক্রীটের জঙ্গলের আধিক্যে প্রাকৃতিক শ্যামলিমার কোন চিহ্ন নেই সেখানে। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হবার বাসনায় বাবা তখন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন সমানে। কঠিন বাস্তবভূমিতে কোন ফাঁক ফোকর নেই। তিন কামরার ছোট ভাড়া বাড়ীতে সংস্কৃতি মনস্ক পরিবার থেকে আসা আমার মা অনিবার্য ভাবেই এই বিপরীত পরিমন্ডলে হয়ে উঠেছিলেন নির্বিকল্প। তাঁর কন্ঠসুধার সুরধারা সাংসারিক মরুপথে হারিয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। আপন সত্ত্বার অন্তর্সলিলা প্রবাহের জন্যেই তিনি ছিলেন ভিন্ন, অন্য জীবনে জীবিতা। এই পার্থক্য বোঝার মত প্রাজ্ঞতা বয়স তখনো আমাকে দেয়নি।
বাবা তখন কর্মসুত্রে মুঙ্গেরে। কালীপুজোর রাত থেকে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলাম তীব্র জ্বরের তাড়সে। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত চেতনা জেগে উঠছিল ডেলিরিয়ামের অসংলগ্ন বাক্যে। দিন দুই পর বিজ্ঞ ডাক্তারবাবু ফিসের টাকা ঠাকুরমার হাতে ফেরত দিয়ে গতি প্রকৃতির ওপর ভরসা রাখতে বলেছিলেন ছোট্ট মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে- “আজকের রাত কাটলে তবেই ক্রাইসিস কাটবে”।
তারপর বহু ক্রাইসিস যুক্ত রাত কাটিয়ে ছেষট্টি বছর পার করে দিলাম, কোন সুত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ মন্থর গতিতে আমার হৃদয়ে প্রবেশ করলেন তার সন্ধান করা আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার কাঁটার পরিক্রমার গতি আন্দাজ করা আমার কাছে সমান দুরুহ। যে কথা বলছিলাম ক্রাইসিস কাটিয়ে ভাল হয়ে উঠেছিলাম ঠিকই, কিন্তু রোগশয্যায় দীর্ঘদিন শুয়ে থাকার ফলে হারিয়ে ফেলেছিলাম হাঁটা চলার ক্ষমতা। সেই প্রথম মা পরিচয় ঘটালেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, তাঁর ছেলেবেলা বই’এর মাধ্যমে। রোগাক্রান্ত মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে লাভ করছে সক্রিয়তা। পরিচ্ছদের পর পরিচ্ছদ মায়ের পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠত সেকালের কলকাতার ছবি, কেমন করে পাল্কী অন্তরীণ নববধুকে চুবিয়ে আনা হত গঙ্গাস্নানের দোহাই দিয়ে। বেলফুলের মালা ও গোলাপি রেউড়ি বিক্রেতারা যেন আমার রোগশয্যার আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করত। সেই বয়সের কল্পনায় রবীন্দ্রনাথকে কখনো মনে হয়নি এক বৃহৎ মাপের গুরুগম্ভীর মানুষ। শাসনঘেরা তাঁর বন্দী জীবন আমারই জীবনের প্রতিচ্ছবি। দূরের বাড়িগুলির মাথা টপকে উঁকি দেওয়া এক পায়ে খাড়া তালগাছের সারিগুলি যখন ঝড়ের দোলায় দুলত, কিংবা ঘোষদের পুকুর পাড়ে নারকেল গাছে কোমরে থলি বেঁধে একটা লোক উঠত পাতা ঝুড়তে , বিছানায় বসে সেই দূরত্ব অতিক্রমের ক্ষমতা ছিলনা, তাই দূর তখনও দূরে বাহির তখনও বাহিরে। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাই তৈরী করে দিয়ে গেল তাঁর প্রতি এক চুম্বকীয় আকর্ষণ। সেটা বুঝেই মা আবৃত্তি করতেন তাঁর স্মরণ থেকেই শিশু কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতার কিছু অংশ।আরো দুর্নিবার হল সেই আকর্ষণ। রোগশয্যায় বায়না বা আবদার পায় আলাদা মর্যাদা। কিন্তু বিধাতা পুরুষের এক অমোঘ নিয়মে ঈস্পিত বস্তু প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধার সৃষ্টি হয়, তার ধারা আজও অব্যহত। সেই কারণেই বোধহয় সাংসারিক বাস্তববুদ্ধি সম্পন্না দিদি মূল্যের কথা বিবেচনা করেই শিশু’র পরিবর্তে নিয়ে এলেন শিশু ভোলানাথ। তাই সই রবীন্দ্রনাথ তো, এ যেন আর এক নতুন জগৎ, সেই মায়াময় হাতছানি আজও দৃষ্টিগোচর হয়।“ যত ঘন্টা তত মিনিট সময় আছে যত/ শেষ যদি হয় চিরকালের মত/ তখন স্কুলে নাই বা গেলাম কেউ যদি কয় মন্দ/ আমি বলব দশটা বাজাই বন্ধ।
স্কুলপাঠ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আসছেন, প্রতিনিয়তই যেন মিল পাচ্ছি নিজের সঙ্গে, রাতে বিছানায় শুয়ে চলে যাওয়া ট্রেনের কুউউউ আওয়াজের সঙ্গে সায়ুজ্য খুঁজে পেতাম – দূরে কোন শয্যায় এক কোন ছেলে/ বংশীর ধ্বনি শুনে ভাবে চোখ মেলে/ যেন সে এক যাত্রী/রাত্রি অগাধ/ জ্যোৎস্না সমুদ্রের তরী যেন চাঁদ/ চলে যায় চাঁদে চড়ে/ সারা রাত ধরি/ মেঘেদের ঘাটে ঘাটে/ ছুঁইয়ে যায় তরী/ রাত কাটে ভোর হয়/ পাখি ডাকে বনে/ চাঁদের তরণী ঠেকে/ ধরণীর কোণে। সেই অসম ভাবনার কোন ব্যাখা আমি দিতে পারব না। রোগশয্যায় অমলের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছি আমার রোগাক্রান্তের দিনগুলির । যত মিল পাই রবীন্দ্রনাথ তত আপন হন।
প্রত্যেক মানুষের জীবনযাত্রার নিজস্ব গতি প্রকৃতি থাকে। সেই গতিতেই বহমান জীবনভোর। পরিবেশের আনুকূল্যে বা বৈপরীত্যে কখনো তার মোড়, কখনো তার বেড়। মায়ের হাত ধরে রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে পরিচয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে মা গাইতেন – তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি’। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, চিচিং ফাঁক শব্দের সঙ্গে ঢুকে পড়েছি আলিবাবা গুপ্ত গুহায়। “ গেয়েছি গান যখন যত আপন মনে খ্যাপার মতো সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী- ছুটে গেছি ক্যালেন্ডার দেখতে তাইতো দুর্গাপুজোর তো একমাসও নেই। রবীন্দ্র সংগীতের এটাই মজা, যে যেমন ভাবে মনে করতে পারে একটা অর্থ সে খুঁজে পাবেই। তাই তো রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকের কাছে তার মত হয়ে ধরা দেন।
তখন আমরা রামরাজাতলায় থাকি, কবিপক্ষে অনুষ্ঠিত হত দক্ষিণ হাওড়া রবীন্দ্র জয়ন্তী। সেই অনুষ্ঠানের সুত্রেই প্রবেশ করলাম এক আশ্চর্য জগতে। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের দিকপাল শিল্পীদের উপস্থিতে রবীন্দ্রময় হয়ে থাকত বছরের তিনটে দিন, বাল্মিকীপ্রতিভা থেকে তাসের দেশ, চিত্রাঙ্গদা থেকে শ্যামা অফুরন্ত ভান্ডার। জীবন নদী তখন অন্য খাতে বয়ে চলেছে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখা বহুরূপী প্রযোজিত তৃপ্তি মিত্র শম্ভু মিত্র অভিনীত রক্তকরবী। চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই নন্দিনীর উচ্ছ্বলতা, বিশু পাগলের জন্যে আকুলতা রঞ্জনের প্রেমে নিমগ্ন নন্দিনী আজও বুকের মাঝে তারুণ্যের সজীবতায় তরতাজা। নন্দিনীর সাহচর্যের লোভে বিশু পাগলের ভবঘুরে ভাগ্যেকেও ঈর্ষা করতে ইচ্ছা করে। সত্যিই পরান কি নিধি কুড়ালো।
সেই প্রথম জাগ্রত হল প্রেম রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। শুরু হল অনুসন্ধান কখনো বাহিরে কখনো অন্তরে কিংবা রবীন্দ্রগ্রন্থের অভ্যন্তরে। কর্মহীন বেকারের একমাত্র বিলাস গ্রীষ্মের দীর্ঘ মধ্যাহ্নকে নিজস্ব ঢঙে অধিকার করা। কত নির্জন দুপুর চিলেকোঠায় পার হয়ে গেছে সঞ্চয়িতা সম্বল করে। অদেখা প্রেমিকার উদ্দেশ্যে বারে বারে ভেঙ্গে গেছে দুপুরের নীরবতা- “ তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার। অবসন্ন দুপুরবেলায় দেখতে পেতাম সাঁওতাল মেয়ের কালো গালে আলো হয়ে ফুটে থাকা ক্যামেলিয়া। রাতের সব তারা দিনের আলোর গভীরে থাকলেও ধরা দিত এক অর্নিবচনীয় রূপে। অবিরত সন্ধান, স্বস্তি দেয় না কিছুতেই, আশ্রয় করি রবীন্দ্র গানে, একই ভাষা একই সুর অথচ কি পরিবর্তনশীল।
একদিন রবীন্দ্রনাটক প্রেমের উন্মেষ ঘটিয়েছিল, কিন্তু কবে তাতে অবগাহন করব, সুযোগ এসে গেল। প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল ‘মুক্তধারা” অভিনয়ের।উদ্দেশ্য ছিল বার বার নাটক পাঠের মধ্যে দিয়ে চরিত্রগুলির সঙ্গে পরিচয় ঘটানো। নিয়ম করে প্রতি রবিবার চলল সেই পাঠানুশীলন। মুক্তধারা’র জলকল্লোলে শীকরকণায় সিক্ত হয়ে উঠত শরীর ও মন। সে মাদকতা বর্ণনাযোগ্য নয়, শুধু অনুভব করতে হয় নিঃসাড়ে। কিন্তু হায় আগেই বলেছি বিধাতা পুরুষের কোন এক করাল অভিশাপে ঈস্পিত বস্তু লাভের ক্ষেত্রে বাধা প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। মহলা যখন জোর কদমে চলেছে, তখনই কর্মপিঞ্জরে প্রবেশের পরোয়ানা জারি হয়ে গেল। আমার আর মুক্তধারা নাটকে অভিনয় করা হল না। অভিজিতের মত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল এক অন্য খাতে।
আগেই বলেছি কর্মজীবন নয় কর্মপিঞ্জর, সূক্ষ্ণ, সুস্থ মানসিকতার প্রবেশ অনেক আগেই নিষিদ্ধ এই জগতে। অপসংস্কৃতির দাপটে রবীন্দ্র ভাবনার বুদবুদ বাষ্পীভবন হয়ে যায় মুহুর্তেই। অনিবার্য ভাবে বাধা পড়ল রবীন্দ্র চর্চার। একমাত্র রোমন্থনে বেঁচে থাকল ফেলে আসা দিনগুলি। মনে পড়ল একলব্যের কথা। বিশাল বটবৃক্ষের পদপ্রান্তে ক্ষুদ্র গুল্মের ন্যায় যদি বেঁচে থাকা যায় রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে। বিরুদ্ধ বিপরীত বাতাবরণে তিনিই তো একমাত্র শান্তির জল। নীরবে শুরু করলাম সাহিত্য চর্চা। শুধুমাত্র তাঁরই কথার পৌনঃপুনিক পরিবেশন। নাই বা থাকল নতুনত্ব, তবু বিন্দুবৎ বেঁচে আছি তাঁর চরণ চেয়ে।
জীবনের অপরাহ্ণ বেলাও শেষ হয়ে আসছে, অনেক খেদ অনেক আক্ষেপ জমা আছে । রবীন্দ্রনাথকে না জানার বেদনা বড় পীড়া দেয়। সাংসারিক পাকচক্রে বারেবারেই বিস্মরণ ঘটছে, সরে এসেছি তাঁর ভাবধারা থেকে। পরক্ষণেই সদাজাগ্রত চেতনা সতর্ক করেছে। সেইজন্যেই নিজেকে এক একসময় ভাগ্যবান মনে হয়। তিনি ছেয়ে আছেন সেই শৈশব থেকে, তিনিই উন্মেষ ঘটিয়েছেন প্রেমের, বেদনায় যুগিয়েছেন সহনশীলতা, ভালবাসায় নীরবতা, অপমানে নিরস্ত করেছেন অশুভ বাক্য প্রয়োগ থেকে। যে সঙ্গিনীর হাত ধরে একদিন মনে হয়েছিল “ এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর”। সেই অটুট বন্ধন আজও অক্ষত রেখে সদাই কলহন্তরিতার উদ্দেশ্যে এই কথাই বলতে পারি “ ওগো চির পুরানো চাঁদ, চিরদিবস এমনি থেকো আমারও এই সাধ, পুরানো হাসি পুরানো সুধা, মিটায় মম পুরানো ক্ষুধা নতুন কোন চকোর যেন পায় না পরসাদ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।