আপনার মতামত

বিষয়ঃ জাতীয় নাগরিক পঞ্জী ও আতঙ্ক

লেখক : ড. অশোককৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক, কবি সুকান্ত মহাবিদ্যালয় ভদ্রেশ্বর, হুগলি

দুপুর বেলায় শুয়ে বিশ্রাম করছি, আমার ভাইঝি সবুজ পাগলাকে এনে হাজির করলো। ওর মতো পাড়ার সব বাচ্ছাদের প্রাণের বন্ধু যে সবুজ পাগলা৷
—- কাকু এন আর সি হলে সবুজকাকুর কী হবে? ও কে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে?
তাই তো এ ব‍্যাটার ঘরদোর বলতে কিছু নেই৷ একেবারেই ভোজনং যততত্র শয়নং হট্টমন্দিরে৷
–এই সবুজ তোর কোনো কার্ড আছে?
–কী কার্ড, লাল না হলুদ?
–ওরে বোকা রেশন, ভোটার, আধার?
–ওসব বালাই নেই, কবে কোথায় থাকি তার ঠিক নেই৷
আর ভোট দিতে আমি চাই না তাই কার্ডের কথা বললেই পালাই৷
–তা হলে আর কি! ভোট দিতে ইচ্ছে হয় না তোর?
–না , ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে৷
এ রকম পাষণ্ডর দেশে থাকার কোন অধিকার আছে!
–হ‍্যাঁ রে তোর জাত কী?
–আমার দাদু বলতো হিন্দুমান, মুক্তির সময় না কি মা বাবা হারিয়ে যায়, এক দাদু আমাকে মানুষ করে৷ সে যাত্রা করে বেড়াতো!
–ও সব শুনে কী করবো? তোর কাছে তো কোন কিছুই নেই৷ তোকে কী করে দেশের নাগরিক বলবে?
এ বার ভাইঝি ফুঁসে ওঠে জলজ্যান্ত মানুষের চেয়ে কাগজের দাম বেশি? আর ও তোমার চেয়ে ভালো দেশের গান গায়৷
সবুজ হাসে, আমার হাজারটা জায়গা, আমাকে তাড়ালে কী হবে?
সারাটা দুপুর ধরে ওদের নাগরিকপঞ্জি বোঝাতে পারলাম না, আপনাদের বিশ্বাস হলো? জানি এরপর যদি বলি স্বপ্নে মান্টো এসে আমাকে টোবাটেক সিংয়ের গল্প বলে গেছেন আপনারা সেটাও বিশ্বাস করবেন না!

 

লেখক : ড: চন্দন কুমার কুণ্ড, অভেদানন্দ মহাবিদ্যালয় সাঁইথিয়া,বীরভূম”

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো/ আমি বিষ পান করে মরে যাবো!”….

এনআরসি ( জাতীয় নাগরিক পঞ্জী)এখন বহু পরিচিত শব্দ, বহুল প্রচলিত শব্দ, আতঙ্ক,আশঙ্কা আর ভয়ার্ত শব্দ।
ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি আর পরিবেশের ভিন্নতায় গড়া আমাদের এই মহান ভারতবর্ষ। ১৯৪৬ এর আগষ্ট থেকে ১৯৪৮ এর আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে এদেশে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ।৬০ লক্ষ মুসলমান এবং ৪৫ লক্ষ হিন্দু ছিন্নমূল উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন।ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তেই প্রায় ৭৫ হাজার নারী চরম লাঞ্ছনার শিকার হন।ইতিহাস বলে, বাংলার অগণিত হিন্দু- মুসলমান এ ভাগাভাগীর সমর্থক ছিলেন না। তবুও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত ও ছিন্নমূল হয়েছিলেন বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষ।অগণিত হিন্দু ও শিখ ওদিক থেকে এদিকে চলে আসেন। ক্রমান্বয়ে অসংখ্য সংখ্যালঘু মানুষ বাংলাদেশ,পাকিস্তান,আফগানিস্থান থেকে এসে বসবাস করছেন এদেশে রুটি রুজী বা এদেশের প্রতি আগ্ৰহী হয়ে। আজ এনআরসির আশঙ্কায় পুনঃরায় ছিন্নমূল হওয়ার আতঙ্ক তাদের শিরায় হিমেল বাতাস বহিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এখনো পর্যন্ত শুধু আসামে নাগরিকপঞ্জীতেই ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে।এক অজানা আশঙ্কা আর ছিন্নমূল হওয়ার ভয় সর্বদা তাড়া করে চলেছে তাদের।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভারতবর্ষ।যেখানে রুটি রুজীর চিন্তা করতেই বহু মানুষের দিন কেটে যায় সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের জায়গা কোথায়!তাছাড়া লক্ষ লক্ষ জনজাতির মানুষ যাঁরা বনে জঙ্গলে বসবাস করেন,যাঁদের অনেকের কাছে এখনো শিক্ষা্য আলো পৌঁছায় নি তাঁরা নাগরিকত্বের প্রমাণ দেবে কীভাবে! হাজারে হাজারে বস্তিবাসীর কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের দলিল পাওয়া যাবে তো? প্রতি বছর যে দেশের অগণিত মানুষবন্যায় বাস্তুহারা হয়ে,সর্বস্ব হারিয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়, ভোট দেওয়ার জন্য১২-১৪দফাপ্রমাণ পত্রের একটিও যাদের কাছে থাকে না,তারা কী কোরবেন?বহু উচ্চবিত্ত ভদ্র সম্প্রদায় ও কী চিন্তিত নন? সম্মান নিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন কী না যে তাঁরা এদেশেরই নাগরিক? সর্বোপরি এদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই যাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়,যাঁরা দেশ ভাগের পরেওপাকিস্তান নয় ভারতবর্ষকেইআপন দেশ ভেবেছেন তাঁরা…..! যা সর্বস্তরের মানুষকে অনিশ্চয়তার আতঙ্কে দিশেহারা করে তার কী খুবই প্রয়োজন?
দেশভাগের সময় সীমান্তবর্তী জেলা গুলি থেকে অনেক নেতৃত্বস্থানীয় দালাল ব্যবসাদার থেকে সাধারণ মানুষের কাছে টাকা তুলেছিলেন তাঁদের জেলা বা এলাকাকে এদেশেই রাখার বন্দোবস্ত করে দেবেন বলে।আদতে তা হয়নি।নাগরিক পঞ্জীর নামে ও দালালরা টাকা তোলা শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। সবচেয়ে ভয়ের হল,’ ৪৬-‘৪৭ এর দাঙ্গায় অনেক শিখ ও হিন্দু মেয়েদের জোর করে পাকিস্তানের মুসলমান পুরুষেরাবিয়ে করতে বাধ্য করেছিল।এর বিপরীতটাও ঘটেছিল।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই মেয়েদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন এদেশের সরকার।আর তাঁরা দ্বিতীয়বার (স্বামী,সন্তান ছেড়ে) ছিন্নমূল হয়েছিলেন। কিন্তু এদেশের হিন্দঙ ও শিখ পরিবার গুলি এই মেয়েদের সংসারে ফিরিয়ে নেয় নি।তাঁদের ঠাঁই হয়েছিল সরকারি ক্যাম্পে নয়তো পতীতা পল্লীতে। নাগরীকত্ব হীন ভারতবর্ষে যাঁদের ক্যাম্পে ঠাঁই হবে এদেশীয় তথাকথিত নাগরিকদের দ্বারা ওই পরিবারের নারীরা সুরক্ষিত থাকবেন তো! যেখানে সারা দেশের নারীর নিরাপত্তাই প্রশ্নের মুখে?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।