আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় বৈশাখী নার্গিস
by
·
Published
· Updated
আ মরি বাংলা ভাষা
লাগাওবে জব তু লিপস্টিক, হিলেলা আড়া ডিস্টিক্ট… এই ভোর রাত থেকে শুরু হয়েছে পার্টি, মোচ্ছব। তার সঙ্গে বাজছে খাইকে পান বনারস ওয়ালা। কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। এদিকে ফেব্রুয়ারির শুরু হয়ে গেছে। কানের মধ্যে গুনগুন করে বাজছে ‘মোদের গরব, মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা। আস্তে আস্তে ভেতরটা শান্ত হয়ে যেতে শুরু করল। আহ কি শান্তি এই বাংলায়। কি মিষ্টি তার আওয়াজ। সারা বিশ্বে ২৬ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে ড্রইং রুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী। উঁহু এখন আর শুধু বোকা বাক্সতে নয়, হাতের মুঠোয় বন্দী। মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে পার্থিব অন্যান্য প্রাণীর একটা প্রধান তফাত এই যে, মানুষের জীবনযাত্রা যেমন অন্যরকম, তেমনই মানুষের একটা সুসংবদ্ধ ভাষা আছে। ভাষার জন্যেই মনুষ্যজাতি একতা সূত্রে আবদ্ধ, আবার ভাষার জন্যই মানুষে মানুষে এত বিভেদ। গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়ে যাওয়া পৃথিবীর ভাষা সংখ্যা কতো তার হদিশ নেই, তার মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় বেশ কিছু ভাষা। আফ্রিকার সেই ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠীর যোগাযোগের একটিই ভাষা ছিল এমন যদি ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সেই হোমোসেপিয়েন্সদের মধ্যে অন্তত আট হাজারের বেষি ভাষা প্রচলিত। একজন হাঙ্গেরিয়ান, একজন তামিল, একজন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। তিনজনই এই পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষ, কিন্তু এদের ভাষার বিন্দু বিসর্গ মিল নেই, মুখোমুখি হলে এরা বোবা হয়ে থাকবে। যদি না ইংরেজি গ্লোবাল ল্যাঙ্গুয়েজে পরিণত হতো।
যদি এমন কখনও হয়, মুখ খুললেই কেউ কেড়ে নেয় কথা বলার অধিকার। যে ভাষায় মায়ের মুখ থেকে শিখেছি কথা বলা, যে ভাষায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম একদিন। যদি কেড়ে নেয় কেউ সেই ভাষা। তাহলে শুধু বোবা হয়ে যাওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। হ্যাঁ এমনটাই তো হয়েছিল সেদিন। যখন সবার উপরে নেমে এলো বাংলা ভাষায় কথা বলা যাবে না। কথা বলতে হবে উর্দুতে। ভারত ভাগের ফলে পাকিস্তান নামে নবীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার মাত্র সাত বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলাভাষায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে, পুলিশের গুলিতে ঢাকা শহরে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি চারজন শহীদ হয়। শুধু ভাষার দাবিতে এমন প্রাণদানের নজির সারা পৃথিবীতে বিরল। এর ফলেই পরবর্তীকালে পাকিস্তান আবার দ্বিখন্ডিত হলে বাংলাদেশের জন্ম হয়, যার অন্যতম কারণও সেখানকার গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি। এর ফলেই এই একুশে ফেব্রুয়ারি দিবসটিকে ইউনেসকো থেকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ভারতেও আসামের কাছাড়ে প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, কিন্তু রাজ্য সরকার সেই ভাষার কোনও অধিকার দেয়নি বলে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয় শিলচর শহরে। সেখানেও মিছিলের ওপর দায়িত্বজ্ঞানহীন পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, মৃত্যু হয় ১১ জন মানুষের। দিনটা ছিল ১ মে, ১৯৬১ সাল। এই চরম শোকের ঘটনা চাপা দেওয়ার চেষ্টাই চালিয়েছিল বরং। ভারতে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৮০০টি, তারমধ্যে ২২টি ভাষা ভারত সরকার স্বীকৃত। যার মধ্যে হিন্দি, বাংলা, তামিলের মতো এগারটি ভাষারই পৃথক জনসংখ্যা এক কোটিরও বেশি। স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল ইংরেজি এবং হিন্দিই হবে সারাদেশের যোগাযোগের ভাষা। যার মধ্যে ইংরেজির প্রাধান্য আমরা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছি। খেতে, বসতে, ঘুমোতে, চলতে ইংরেজিই আমাদের হয়ে উঠেছে পরম আত্মা। আর হিন্দি আমাদের মুখের বুলি। বাংলাকে আমরা কোথায় যেন একটা দূর গ্রহে পাঠিয়ে দেওয়ার খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছি। ছেলেমেয়েদের বাংলা না শিখিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি ইংরেজি মিডিয়ামে। যে ভাষার জন্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে গিয়েছিল বাংলা জাতীয়তাবাদ এবং একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন। শুধু যে ১৯৭১ সাল তা কিন্তু নয়, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ভাষা অবজ্ঞার শিকার হয়েছে, শাসকদের দ্বারা, ফতোয়াবাজদের দ্বারা। একসময় বর্ণ ব্রাহ্মণরা ফতোয়া দিয়েছিল, বাংলা ভাষায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করলে রৌরব নরকে যেতে হবে। পরবর্তীকালে মোল্লারা বলল, পবিত্র আরবি ভাষা অনুবাদ করে যারা দেশি ভাষায় কাব্য রচনা করে তারা মোনাফেক। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘নীল ময়ূরীর যৌবন’ এ পড়েছি। চর্যাপদের কবি কাহ্নপা রাজদরবারে গিয়েছিলেন বাংলা ভাষার কবিতা পড়তে। তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি রাজদরবারে। তারপর সামন্তরাজা ওই বঙ্গকবির হাত কেটে দিয়েছিল, যাতে সে আর কখনো অপবিত্র ভাষায় কবিতা লিখতে না পারে।
এমনটাও বলা হতো বাংলা ভাষা অভিজাতদের ভাষা নয়। অভিজাতদের ভাষা হচ্ছে সংস্কৃত, আরবি-ফার্সি-ইংরেজি-উর্দু। বাংলা ভাষা এসেছে প্রাকৃত ভাষা থেকে। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সমাজের অতিনিম্ন স্তরের লোকেরা বসবাস করত। তাদের ভাষাই ছিল প্রাকৃত ভাষা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, প্রাকৃত থেকে প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত, তা থেকে গৌড়ীয় প্রাকৃত, সেখান থেকে বঙ্গকামরূপী, তার থেকে বাংলা। এই চর্যাপদের কবিরা রাজরোষের শিকার হয়েছিলেন। কারণ তখন বঙ্গদেশের সামন্ত রাজারা দৈবভাষা সংস্কৃতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তারা স্থানীয় অনার্য ভাষা পছন্দ করতেন না। এ ভাষায় ঈশ্বর বন্দনা করাও নিষেধ ছিল। তাদের রক্তে গৌড়ের, বঙ্গের, রাঢ়ের রাজপথ হয়েছিল লাল। তাই তারা বাংলাভাষার পান্ডুলিপি নিয়ে নেপালে পালিয়ে গিয়েছিল। যা পরবর্তী কালে ১৯০৭ সালে ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্থশালা থেকে উদ্ধার করেন।
ইংরেজরা যখন এদেশ থেকে বিদায় নেয়, বাংলাভাষা ততদিনে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালের আগে বড়লাট লর্ড কার্জনও চেয়েছিলেন বাংলাভাষার অখণ্ডতা বিকৃত করতে। পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। বাংলাভাষা সংস্কৃত ফোঁটাকাটা পণ্ডিতদের পরাজিত করতে না করতেই শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানি শাসক আর মোল্লাদের শত্রুতা মোকাবেলা করার শুরু। পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে, উর্দু চলে গেছে, বিদায় নিয়েছে ইংরেজও। ইংরেজ চলে গেলেও ইংরেজিয়ানা রয়ে গেছে।
এতো এতো লড়াই করে বাংলাভাষা। আমার, আপনার, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বলতেই পারি, যে ভাষায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, যে ভাষায় মা ডাকতে শিখেছি, সে ভাষাকে রক্ষা করার দায়ীত্ব আমার। মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের লড়াইটা এখন আর অধিকার প্রতিষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ নেই। লড়াইটা যথাযথ শিখন, ব্যবহার ও চর্চা এবং এর বিকাশ নিয়েও। ভাষার মাসে এটুকুই চাই, স্বাস্থ্যবান মাতৃভাষা, যা পরনির্ভর এবং অসুখপ্রবণ নয়, যার ভেতরের গানটা সুর তাল লয় হারাবে না। অন্যভাষার আগ্রাসনে অপমৃত্যু হবে না ‘আমাদের ভাষার’।
সবশেষে বলতেই হয়, একটি সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভাষা অপরিহার্য। ভাষা হল মানবসভ্যতার স্পন্দন। ভাষা নিয়ে লড়াই নয়। ভাষা হোক মুক্তি ও মানবিকতার জন্য। ভাষা হোক ভালবাসার জন্য।