অরুণাভ দাসের ফটোফিচার

আমবাগানের ওপারে প্রথম দেখা পত্রলেখা

জলছবির নাম পত্রলেখা

মৃত ও জীবিত গাছের সখ্যতায় সময় যেন থেমে আছে

বর্ষা যাপনে এসেছি পুরনোকালের মানভূমে। দুদিন ধরে প্রচুর ঘোরাঘুরি। খামখেয়ালি রূপ দেখছি প্রকৃতির। কখনো মেঘ, কখনো রোদ্দুর। দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে যখন তখন। খুব মনে আছে, ছোটোবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলাম পুরুলিয়া হল বন্ধ্যা মাটির রুক্ষ জেলা। চারদিকে পাহাড় আর পাথর। চাষাবাদ তেমন হয় না বললেই চলে। জলের অভাব প্রকট। জেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যত ঘুরছি, অনেককাল ধরে লালন করা ধারনাগুলি দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে। থাকতে না পেরে সফরসঙ্গী অভিজিতকে একসময় বলেই বসলাম, ‘আচ্ছা, তাহলে কি আমাদের স্কুলের বইতে ভুল লিখেছিল? এ তো যেদিকে তাকাই, চোখজুড়ানো সবুজের সমারোহ। আর কতই না বাঁধ, বিল, দীঘি; যেঁ দিকে তাকাই জলের আয়নায় মুখ দেখছে প্রকৃতি।’ অভিজিতের মনেও একই রকম সংশয়, কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। নিজের প্রতি রাগ হল, কেন এতকাল পুরুলিয়ার দিকে সেভাবে ফিরে তাকাইনি, অথচ ছুটি পেলেই সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। এইভাবে অচিন মানভূম আবিষ্কারের মহা বিস্ময় বুকে করে পুরুলিয়ায় দুদিন কেটে যাবার পর এখানকার বন্ধু ও বিশিষ্ট লেখক ভাস্কর বাগচী বাবু প্রস্তাব দিলেন, ‘চলুন আপনাদের শহরের খুব কাছে একটা অল্পচেনা কিন্তু অপরূপ জায়গা দেখিয়ে নিয়ে আসি। জায়গার নাম পত্রলেখা ড্যাম।’ তার মানে আবার জলের কাছে। যেখানে জল সেখানেই অফুরান সবুজ। চোখ ও মনের মহাভোজ একই সঙ্গে। প্রস্তাব শোনা মাত্র লুফে নেওয়া। বাহন প্রস্তুত ছিল  হোটেলের দরজায়, দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম।

তখন বিকেল, নীলিমার নীল মেখে কুলায় ফিরছে পত্রলেখার পাখিরা

পুরুলিয়া শহর থেকে বাঁকুড়া যাবার রাস্তা ধরে ২০-২২ মিনিটে হুটমুড়া গ্রামে পৌঁছে গেলাম। ঝাঁ চকচকে রাস্তাটা নতুন করে সংস্কার হয়েছে, যাকে বলে মাখনের মতো মসৃণ। হুটমুড়া বাজার এলাকায় হাইওয়ে ছেড়ে বাঁদিকে ঢালাই রাস্তায় নেমে যাই। হাইস্কুলের পাশ দিয়ে বাঁক নিয়ে সটান মাঠে। পত্রলেখা ড্যামে যাবার নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। থাকলেও চালক সহ আমাদের চার জনের জানা নেই। ঢালাই রাস্তাটা অবশ্য সামনের দিকে চলে গিয়েছে। ঘুরপথ এড়িয়ে ঢেউখেলানো লাল মাটির মালভূমির ওপর দিয়ে গাড়ি ছোটে। বর্ষার শুরুতে সবুজের বান ডেকেছে রুখা জেলা পুরুলিয়ায়। সকালের ট্রিপে পাহাড় ঘেরা মুরগুমা ড্যাম ও কাঁসাই নদীর পাড়ে প্রাচীন মন্দিরের গ্রাম দেউলঘাটা ঘুরে এলাম। সবুজের অভিযান দেখে ফিরেছি। এই বিকেলের সফরে সবুজ যেন আরও জমকালো, চারদিকে খেজুর ও অন্যান্য গাছের মেলা দেখছি। একটু উঁচুতে লোভনীয় কাঁচা পাকা খেজুরের থোকা ঝুলছে। গাছের নিচে পড়ে বিছিয়ে আছে। এমন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা প্রকৃতির দান, লোভ সামলানো গেল না। গাড়ির চালক ও সঙ্গী অভিজিৎ গাড়ি থামিয়ে মাঠে নেমে পড়ে খেজুর কুড়াতে শুরু করে দিল। দুপুরে খাবার পড় নাকি ফলাহার শ্রেয়। কিন্তু মাটি থেকে কুড়িয়ে কত আর মন ভরে? ঢিল ছুড়ে প্রচুর খেজুর গাছ থেকে পেড়ে ফেলল দুজনে। সকলে মিলে জমিয়ে বসে খেতে খেতে আবার লাফাযাত্রা মালভূমির ওপর দিয়ে।

কয়েকশ মিটার চলতেই একটা মাঝারি আকারের আমবাগানে গিয়ে পড়লাম। সকালেও একটি বিশাল আমবাগান দেখে এসেছি পুরুলিয়া ও জয়পুরের মধ্যবর্তী স্থানে। জায়গার নাম চাঁদের হাট। সেখানে সত্যই সপ্তাহে একদিন গাছগাছালির ছায়ায় হাট বসে। পত্রলেখার আমবাগানে আলো ছায়ার জাফরিকাটা মাটি। তার ওপাশে টলটলে জলরাশি দেখা যাচ্ছে। শীতকালে এই আমবাগানে যে পিকনিক পার্টির মেলা বসে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এখন পিকনিকের মরশুম নয়, সব শুনশান। ভাস্কর বাগচী জানালেন, কিছুদিন আগে আম গাছের সংখ্যা আরো বেশি ছিল। অজ্ঞাত কারণে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। একটা বিরাট মরা গাছ সামনেই সেই স্মৃতি নিয়ে বচত্র ভঙ্গিমায় মাটিতে শুয়ে আছে। এখন জুলাইয়ের শেষ, বর্ষা সবে শুরু হয়েছে। পাতলই নদীর পত্রলেখা জলাধারে খুব বেশি জল নেই। আমবাগানের প্রান্তে পাশাপাশি দাঁড়ানো তিনটি তালগাছ শীতকালেও জলে ডোবা থাকে। এখন জল সেখান থেকে অন্তত ২৫ ফুট দূরে সরে গিয়েছে। ভাস্কর বাবু বললেন, পুরুলিয়া শহর থেকে মাত্র ১৭-১৮ কিমি দূরে হলেও সেখানকার কম লোক পত্রলেখা ড্যামের হদিশ জানেন। যদিও হাইওয়েতে বাঁকুড়ার দিকে যেতে সকলেই পাতলই নদীর সেতু অতিক্রম করেন। সেই পাতলইয়ে বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করা হয়েছে মূলত রুখাসুখা পুরুলিয়ায় সেচের জল যোগান দেবার জন্য। এর ফলে এইসব এলাকার মাটির চরিত্র বদলে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। আশপাশের গ্রামে চাষ শুরু হয়েছে, যা ১০ বছর আগেও ভাবা যেত না। আমাদের ডানদিকে স্লুইসগেট দেখা যাচ্ছে খানিকটা তফাতে। তার কাছে পাড়ে বসে দুজন গ্রামবাসী ছিপ ফেলে মাছ ধরছে, কোনোদিকে নজর না দিয়ে। পত্রলেখা জলাধারকে এক নজরে দেখলে নদী বলে মনে হয়। টানা অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে বাঁ দিকে। ওপারে মালভূমির লালমাটির উথালপাথাল, এদিকের মতোই। তার ওপ্রান্তে আকাশ যেখানে মাটিতে মিশেছে সেখানে গ্রামের আভাস। আমবাগান ছাড়িয়ে সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ গড়িয়ে নেমে গিয়েছে জলের কিনারায়। সামনে লোহার পায়েচলা ব্রিজ যা জলাধারের মাঝখানে পাম্পহাউস পর্যন্ত গিয়েছে। ৪০ ফুট দীর্ঘ তো হবেই। কিন্তু ব্রিজের একাংশ ভেঙে পড়েছে। আমরা আধ রাস্তায় তালাবন্ধ গেট পর্যন্ত গেলাম জলের ওপরে দাঁড়িয়ে আমবাগানের ছবি তোলার জন্য। আশপাশে কেউ কোথাও নেই। ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনে হল যেন নদীর বুকে লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বিকেলবেলায় বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছে। জলে ঢেউ উঠছে। গরম ভাব কেটে গিয়ে শরীর জুড়িয়ে গেল। চোখ মেলে দিই দূরান্তে। জলরাশির ওপারে মুঠো মুঠো সবুজ। বিরাট আমবাগান ছবির মতো লাগে। মুগ্ধতায় ঘোর লাগার উপক্রম। মনে মনে ধন্যবাদ দিই, তিনি আগ্রহ করে না দেখানে নিয়ে এলে কোনোদিন আসা হত না। এ যেন বেলা শেষের কুড়নো মানিক।

পাম্পহাউসের সামনে থেকে দেখা আমবাগানে আলোছায়ার আলপনা।

মাথার ওপর বর্ষার মেঘলা ভাঙা আকাশ। ঘন নীলের বুকে অগণিত সাদা কালো ও ধূসর মেঘ ভেসে চলেছে। ছোটো বড়ো মেঘের দল কখনো পশু পাখি, আবার কখনো পালতোলা নৌকার আকার নিচ্ছে যেন। অনেক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। এমন পরিবেশে এলে নিতান্ত বেরসিক মন কবি বা শিল্পী হয়ে যেতে বাধ্য। আকাশের প্রতিবিম্ব ধারণ করে জলাধারের জলের রঙ ঘন নীল। কোথাও মেঘের ছায়া পড়ে সাদা ছোপ। আবার কোথাও ঝুঁকে পড়ে রূপ দেখছে বনবাদাড়। হালকা হাওয়ায় ছোটো ছোটো ঢেউ খেলছে। সবুজ, সাদা ও নীলের জমকালো মিশেলে সে এক সত্যিই মায়াময় জলছবি। অনেক ছবি তোলা হল। ক্রমশ পড়ে আসা বিকেলের কমলা ঘেঁষা সোনা হলুদ আলো ছায়ার খেলায় চারদিক ক্রমশ আরো প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে থাকে। আমবগানের ছায়ায় বসে পত্রলেখার সান্নিধ্যে অনেকটা সময় বয়ে যায় অজান্তে।

দিনের আলো পশ্চিমে অনেকখানি ঢলার পর শহরে ফেরার রাস্তা ধরি। কিন্তু এবারেও খেজুরতলার অমোঘ ও মিষ্টি হাতছানি কোনোমতে এড়ানো গেল না। সুতরাং, আবার গাড়ি থামানো, আবার ঢিল ছোড়া, ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে আনা ও মুখ চালানো। আজ সকালে যে জায়গার নাম পর্যন্ত জানতাম না, সেই পাতলই নদীর পত্রলেখা জলাধারের কাছে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো হঠাত ফিরে পাওয়া ছেলেবেলার এক টুকরো সযত্নে বন্ধক রেখে এলাম। সকলে মিলে ঠিক হল, আগামি বসন্তে পলাশ ফুলের প্রাচুর্য দেখতে আবার পুরুলিয়া আসব তখন পুনর্বার পত্রলেখার কাছে হাজিরা দিয়ে যেতেই হবে।

প্রয়োজনীয় তথ্য: হাওড়া থেকে রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ভায়া টাটা, লালমাটি এক্সপ্রেস, রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস, চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ইত্যাদি ট্রেন পুরুলিয়া যেতে কমবেশি সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় নেয়। পুরুলিয়া থেকে দু’ঘণ্টার জন্য গাড়ি ভাড়া নিয়ে হুটমুড়া গ্রামের অদূরে পত্রলেখা জলাধার ঘুরে আসা যাবে। যাওয়া আসা মিলিয়ে খুব বেশি হলে ৩৫-৩৬ কিমি। এক যাত্রায় প্রায় সমদূরত্ব অতিরিক্ত চললে আর একটি অচিন জলাধার ফুটিয়ারি ড্যাম ঘুরে আসতে পারবেন। আকারে পত্রলেখার চেয়ে বেশ খানিকটা বড়ো। ওপারে একলা পাহাড়ের ছায়া। দু’চারজন টিউব ভাসিয়ে তার ওপরে চড়ে মাছ ধরতে নামে। শীত বসন্তে পিকনিক ও বেড়ানোর মরশুমে নির্দিষ্ট ভাড়ায় বোটিংয়ের ব্যবস্থা থাকে।

থাকার ব্যবস্থা পুরুলিয়া শহরে। নানা রকম দামের অনেক হোটেল ও গেস্টহাউস আছে। আকাশ সরোবর ও পার্ল ট্রি হোটেল দুটি বেশ ভালো মানের। সাহেব বাঁধ নামে বিরাট জলাশয়ের ধারে মনোরম পরিবেশে আকাশ সরোবরে আমরা ছিলাম। এখানে এসি ডবল বেডরুমের ভাড়া ব্রেকফাস্ট সহ ১৮০০ ও ২৫০০ টাকা।

                                                                                                   লেখা ও ছবিঃ অরুণাভ দাস

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।