অমিতাভ রায়ের গল্প “প্রথম রিপুর ফাঁদে”

গ্রামের শেষপ্রান্তে নদীর পাড়ে দেবী চন্ডীর মন্দির। সেখানে গ্রামের সব বুড়োর আড্ডা বসে। সেই আড্ডার মধ্যমণি হলো প্রতুলকান্তি সিনহা। গ্রামের ছোটদের কাছে সিংহদাদু। সিংহদাদুর গল্পের স্টক অফুরন্ত। তাই সিংহদাদু ওদের খুব প্রিয়। ছোটরা যখন থাকে, তখন সিংহদাদু ভূতের গল্প বলে। কিন্তু, শুধু বুড়োরা থাকলে প্রতুলকান্তি সিনহার গল্পের বিষয় বদলে যায়। সেরকমই একদিন আজ। সকাল থেকেই মেঘে ঢাকা আকাশ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। আজ কমবয়সী ছেলেপুলে কেউ নেই। তাই প্রতুলকান্তি বিড়িতে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো, ” ষড়রিপু বলতে তোমরা কি বোঝো?” মহাদেব জানা হাসতে হাসতে বললো, ” কে না জানে? কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ আর মাৎসর্য। ” ” এ মদ কিন্তু সে মদ নয়-চাটুজ্যে যা ঘরের দরজা বন্ধ করে বউকে লুকিয়ে গ্লাস গ্লাস পান করে। ” প্রবীর চ্যাটার্জীর মুখ লাল হয়ে যায়। বলে,” মোটেই গ্লাস গ্লাস খাই না, পরিমিত খাই। আর বউকে সবাইই কিছু না কিছু লোকাও। ” চ্যাটার্জীর কথায় কান না দিয়ে প্রতুল কান্তি বলে,” মদ হলো নিজেকে বড়ো, শ্রেয় বা উন্নত মনে করা। তা, ষড়রিপু বিষয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তোমরা যদি শুনতে চাও-তাহলে বলতে পারি। ” এ কথা বলেই প্রতুলকান্তি সিনহা আড়চোখে পরিমল বসুর দিকে তাকায়। এই পরিমল বসু প্রতুলকান্তির গল্প শুনতে শুনতেই অনেক ব্যাঁকা ব্যাঁকা মন্তব্য করে। যৌবনে নাকি এই দুজনেরই গ্রামের এক নারীর প্রতি আসক্তি ছিলো। সেই থেকেই দুজনের রেষারেষি। তবে দুজনের কেউই সেই নারীকে পায় নি। সেই ঘটনার অভিঘাতে প্রতুলকান্তি চিরকুমার থেকে গেছে- দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়ে আবার গ্রামে এসে থিতু হয়েছে। অসীম মান্না বলে,” গল্প বলো-গল্প বলো সিনহা। শোনার জন্যই তো বসে আছি। ” প্রতুলকান্তির বিড়ি তখন শেষ। অগত্যা নাকে নস্যি নিয়ে শুরু করে।
” তাহলে প্রথম রিপু দিয়েই শুরু করা যাক। ” উৎসাহী চোখগুলো তাকিয়ে থাকে প্রতুলকান্তির দিকে। আকাশ তখন কিছুটা পরিষ্কার। সূর্যের হালকা আভায় চারদিক বড়ো মনোরম। দূরে নদীর মাঝখান দিয়ে ভেসে যাচ্ছে কয়েকটা জেলে নৌকা। ” আমি তখন রাঁচীতে বুঝলে। একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করি। আমাদের অফিসের গাড়ির ড্রাইভার ছিলো স্থানীয় এক যুবক দীনেশ। ছেলেটা গাড়ি খুব ভালো চালায়। একদিন ওর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েওছে। বৌটা সুন্দরী – চোখ ফেরাতে পারবে না। সবার ভাগ্যে এরকম বৌ জোটে না। ” এ কথা বলেই প্রতুল চন্দ্র তাকায় পরিমলের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পরিমল চোখ সরিয়ে নেয়। প্রতুলকান্তির মুখে একটা কৌতুকের হাসি দেখা দিয়েও মিলিয়ে যায়। দীনেশ ছেলেটা হাসিখুশি – ভালোই লাগে আমার। একবার অফিসের একটা কাজে রাজারাপ্পা মন্দিরের কাছে গিয়েছিলাম। ভাবলাম পুণ্যার্জন করা যাক। পুজো দিতে ঢুকলাম। যারা ওখানে গেছো তারা জানো বেশ কিছুটা হাঁটতে হয়। দীনেশ বাইরে ছিলো গাড়ি নিয়ে। পুজো দিয়ে বেরিয়ে দেখি গাড়ির সামনে খুব ভীড়। ভীড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি এক যুবতী যা-তা বলছে দীনেশকে। দীনেশ গাড়ির ভিতরে চুপ করে বসে আছে। যুবতীর কথা শুনে বোঝা গেলো ও দীনেশের প্রথম বউ। দীনেশ ওকে ছেড়ে ওর বোনকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কোনরকমে সেদিন দীনেশকে নিয়ে ফিরতে পারলাম। সারা রাস্তা দীনেশ কোনো কথা বলেনি। আমি ভাবলাম, ঐরকম সুন্দরী শালীকে দেখে ও নিজেকে সামলাতে পারে নি। অফিসে পরের দিন আলতাফকে বলতে ও বললো, ” দীনেশ ছেলেটা শালী কেন- যুবতী মেয়েদের দেখলেই নিজেকে সামলাতে পারে না। ” খুব একটা বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু, আমার সে বিশ্বাস ভেঙে গেলো একটা ঘটনায়।” কথা থামিয়ে প্রতুলকান্তি আরেকটা বিড়ি ধরালো। ততক্ষণে সবার কৌতূহল অনেক বেড়ে গেছে।
” একদিন দেখি, দীনেশের সেই অপূর্ব সুন্দরী বউ রামিয়া এসে হাজির হয়েছে অফিসে। তার অভিযোগ হলো, দীনেশ সময়ে ফিরছে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা কান্ড ঘটাচ্ছে। একদিন ওকে নাকি মেয়েদের পোশাকের দোকান থেকে কিছু কিনে বেরোতে দেখা গেছে। সেই খবর পেয়ে রামিয়া ভেবেছিলো ওর বা মেয়ের জন্য কিছু কিনেছে দীনেশ। কিন্তু, দীনেশ ফিরেছিলো খালি হাতে। সুতরাং ওর সন্দেহ আরো বাড়ে। রামিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেদিন অনেক কষ্টে বাড়ি ফেরানো হলো। আলতাফ বললো, ” অফিসের উল্টোদিকে মুদির দোকানীর বউটার সঙ্গে আশনাই আছে দীনেশের। ও নিজের চোখে একদিন দেখেছে। ” আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। সেই বউটাকে আমি দেখেছি। ভয়ঙ্কর দেখতে! আলতাফকে সে কথা বলতে ও বললো,” ভাদ্রের কুকুর আর দীনেশের কোনো তফাত নেই। ” আমি কিছু বললাম না। বুঝলাম প্রথম রিপু ওকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটলো একটু অন্যরকম। আমাদের অফিসে আরেকজন ড্রাইভার ছিলো। তার নাম প্রসাদ। প্রসাদের বয়স হয়েছে। বউ মরে গিয়েছে।একটাই মেয়ে- নাম লছমি সেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে নাকি ও কাজ ছেড়ে দেবে। একথাই সবাইকে বলে প্রসাদ। একদিন শোনা গেলো লছমি নাকি গর্ভবতী। আর, তারজন্য দায়ী দীনেশ। ভাবলাম আর অফিসে আসবে না প্রসাদ। কিন্তু, তাতো হলো না। প্রসাদ অফিসে দিব্যি আসে। হাসিমুখেই আসে। কিন্তু, দীনেশকে আর দেখা গেলো না। ওর বউ খোঁজাখুঁজি করলো, পুলিশে খবর দিলো। বুঝলাম দীনেশ এবার ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। নতুন ড্রাইভার এলো অফিসে। লছমির কয়েকবছরের মধ্যে বিয়েও হয়ে গেলো। খেয়েও এলাম। প্রসাদ চাকরি ছেড়ে দিলো। ওকে ভুলেও গিয়েছিলাম। একদিন অফিসে পুলিশ এলো। শুনলাম প্রসাদকে পুলিশ ধরেছে। আলতাফ বললো,” দীনেশকে খুন করে প্রসাদ কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। ধরা পড়ে গেছে কুয়োর জল শুকিয়ে যেতে। রাস্তায় বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছিলো। বল পড়ে গিয়েছিলো কুয়োয়। সেই বল খুঁজতে গিয়েই ওরা কঙ্কালটা খুঁজে পায়।” বুঝলাম প্রথম রিপুর প্রভাবে কি ভয়ানক পরিণতি হতে পারে! ” সবাই নীরব। প্রতুলকান্তি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললো, ” সবাই তো তা বোঝে না। নইলে প্রেমে ব্যর্থ হয়েও কেন কেউ কেউ পাশের বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে।” ওর কথা শেষ হতেই পরিমল কোনো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে এলো। রহস্যময় এক হাসি ফুটে উঠলো প্রতুলকান্তির মুখে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।