অনুবাদ সাহিত্যে সোমনাথ রায়

‘লা মুয়েরতে’(মরণ) আর এক গল্প-বলিয়ে

ডোমিনিকান রিপাবলিকের লোককথা        

ফেয়িতো মোলিনা

মন্টি ক্রিস্টিতে একসময় একজন গরীব লোক ছিল যে সবসময় বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখত (সেটা আর নতুন কথা কি – সব বড়লোকরাই আরও বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখে তো গরীবরা তো দেখবেই)। তার নিজের বলে কেউ ছিল না, তার নিজস্ব বলেও কিছু ছিল না, কিন্তু সে অদ্ভুত ভাল গল্প বলতে পারত আর খুব আশ্চর্য রকমের স্বপ্নের জাল বুনতে পারত – যদি সে কখনও সত্যিকারের ধনীলোক হয় তাহলে সে কী করবে, কী দেখবে আর কী কিনবে। দিনের পর দিন সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকত।
একদিন হটাৎ ‘লা মুয়েরতে’ বা মরণ তার সামনে আবির্ভূত হ’ল।
মরণ তাকে বলল – “আমি তোমার পুরো দায়িত্ব নিচ্ছি। আমি তোমাকে একটা নতুন কাজের সন্ধান দিচ্ছি। তুমি এবার থেকে ডাক্তা্রি করবে আর পৃথিবীতে যে কোন অসুখ শুধু রোগীর গায়ে হাত রেখেই সারিয়ে তুলতে পারবে। রোগীর ঘরে ঢুকে যদি আমাকে রোগীর পায়ের দিকে দেখতে পাও তাহলে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার যে সেই রোগী এ’যাত্রায় বেঁচে গেল আর যদি মাথার দিকে দেখ তাহলে সাধু সাবধান – ওই রোগীর আত্মাটি আমার!”
এই ব্যবস্থায় ঐ দরিদ্র গল্পকথকের আনন্দ তো আর ধরে না! সে তক্ষুণি শহরে গিয়ে চেম্বার খুলল আর ডাক্তারি করতে শুরু করে দিল। তার চিকিৎসায় রোগীরা আশ্চর্যজনক ভাবে সেরে উঠতে লাগল। দাবানলের মত এই খবর সারা শহরে, দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল যে শহরে একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন চিকিৎসক এসেছে আর অল্প দিনের মধ্যেই এই সংবাদ রাজপ্রাসাদেও পৌঁছে গেল যেখানে রাজার একমাত্র কন্যা ভীষণ ভীষণ অসুস্থ হয়ে বহুদিন বিছানায় পড়ে আছে।
রাজা তৎক্ষণাৎ ডাক্তারকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে বললেল – “আমার মেয়ে ভীষণ অসুস্থ। তুমি যদি ওকে সুস্থ করতে পার তাহলে আমি তোমাকে বড়লোক করে দেব আর আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব। কিন্তু এটাও জেনে রাখ, মেয়ে যদি মারা যায়, তাহলে তোমারও গর্দান যাবে”।
ডাক্তার তার জাদু ক্ষমতায় ভরসা করে সোজা রাজকন্যার ঘরে চলে গেল কিন্তু ঘরে ঢুকেই আতঙ্কে তার চুল খাড়া হয়ে গেল কারণ সে দেখল ‘লা মুয়েরতে’ বা মরণ রোগিণীর মাথার দিকে দাঁড়িয়ে আছে।
সে পাগলের মত ভাবতে থাকল – “এবার আমি কি করি? রাজকন্যা যদি মারা যায় আমি ফৌত হয়ে যাব”।
এমন সময়ে বিদ্যুৎ চমকের মত একটা বুদ্ধি তার মাথায় এল। ডাক্তার রাজকন্যার পালঙ্কটা ধরে পুরো ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে দিল – এখন ‘লা মুয়েরতে’ খাটের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবু চট্‌ করে রাজকন্যার গায়ে হাত রাখল। কন্যে সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে গোল গোল গোলাপী গাল মুখে উঠে বসল আর ‘লা মুয়েরতে’ ক্রোধোন্মত্ত হয়ে দুর্গ থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।
রাজামশাই সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন – “আমার শর্তানুযায়ী রাজকুমারী তার জীবনরক্ষককে জীবনসঙ্গী করবে”।
ডাক্তারবাবুকে পরের দিন বিয়ের প্রস্তুতির জন্য রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠানো হ’ল। অযাচিত সৌভাগ্যে খুশীতে ডগমগ হয়ে যেই সে প্রাসাদের বাইরে পা রেখেছে  কেউ একজন তার হাতটা চেপে ধরল।
‘লা মুয়েরতে’ বা মরণ তার জন্য দুর্গের দরজাতেই ওঁত পেতে বসে ছিল।
সে হিস্‌ হিস্‌ করে তাকে বলল – “তুমি আমার সঙ্গে আসছ” আর তাকে সোজা স্বর্গের এমন জায়গায় নিয়ে গেল যেখানে লোকেদের জীবনপ্রদীপ প্রজ্বলিত ছিল। প্রত্যেক জীবনের প্রতীক একটি তেলের প্রদীপ, কোনটির শিখা উঁচু হয়ে উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে আবার কোনটির শিখা নিভু নিভু। ‘লা মুয়েরতে’ একটা প্রদীপের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল যেটা পটপট আওয়াজ করে নিভতে বসেছে।
সে জানালো – “ওটা তোমার নিজের জীবনপ্রদীপ। তুমি আমাকে ঠকাতে চেয়েছিলে, সেইজন্য তোমার খেল এবার খতম। তোমার আয়ু আর পাঁচ মিনিট মাত্র”।
মর্মান্তিক আঘাত পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে ডাক্তার চীৎকার করে উঠল – “পাঁচ মিনিট?!” সে লক্ষ্য করল কাছেই একটা টেবিলে প্রদীপে দেওয়ার তেল ভর্তি একটা ডিবে রয়েছে। সে ‘লা মুয়েরতে’র দিকে ফিরে বলল – “বেশ, ঠিক আছে। কিন্তু আমার মৃত্যুর আগে শেষবারের মত আমি একটা গল্প শোনাতে চাই। এটা সত্যিই একটা দারুণ গল্প, আমার মনে হয় আপনার ভাল লাগবে”।
“বেশ, শুরু কর তাহলে” – ‘লা মুয়েরতে’ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ডাক্তারও বলতে শুরু করল। সে এমন আশ্চর্যজনক, এমন বিস্ময়কর, এমন অবিশ্বাস্য সুন্দর একটি গল্প বলল, যেটা ওর সারা জীবনে বলা শ্রেষ্ঠ গল্প, যাতে ‘লা মুয়েরতে’ একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল … আর কথক গল্প বলতে বলতে তার পেছনে হাত বাড়িয়ে ডিবেটা কাত করে নিজের প্রদীপটায় তেল ভরে দিল। সে এতটাই তেল ভরেছিল যে এখনও বহাল তবিয়তে সে বেঁচে আছে।
এই গল্পটা থেকেই আমরা জানতে পারি যে ‘লা মুয়েরতে’ বা মৃত্যু গল্প বলার কাছে কি করে হেরে গিয়েছিল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।