অণু উপন্যাসে জারা সোমা

দোলাচল

শেষাংশ

৬. 

অন্ধকার থেকে আগুনের ভাটার মতো দুটো চোখ যেন গিলতে আসছে!ওকে দেখেই ঝাঁপ দিল বনবেড়ালটা।টাল সামলাতে না পেরে পড়বার মুহূর্তে কে যেন ওকে ধরে ফেলল! ঘুরে দেখে ওর বন্ধু মৈত্রী।অবাক হয়ে জানতে চাইল,কি হয়েছে?তিতলির মুখে সব শুনে হেসে খুন।টানতে টানতে নিয়ে গেল বার্থে।বলল, প্রয়োজন পড়লে যেন ডেকে নেয় তিতলি।ফোনের নেটওয়ার্ক এই আছে তো এই নেই।বেশ খানিকটা সময় ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করে ঘুমিয়ে পড়ল তিতলি।
এদিকে বহুদিন পর বৈভব ও মৌ এতটা কাছাকাছি , সম্পর্কে সময় যে মরচে ফেলেছিল,তা আজ মিটে গেল এক লহমায়। সেই আগের মতো ফিরে এলো দাম্পত্য।ঘন হয়ে বসে কথা বলল,নিজেদের ভালো লাগা,অভিমান,অনুযোগ নিয়ে। আজ দুজনকেই পেয়ে বসেছে আবিষ্কারের নেশা , ঠিক তখনই বেজে ওঠল বৈভবের ফোনটা।
হ্যালো বলার পরেও ওপ্রান্তে আশ্চর্য নীরবতা।
এমন করে বেশ কয়েকবার হবার পরে তাল কাটল দুজনেরই। যদিও মুখে বলল  না কেউই।তবুও বৈভব অস্থির হল মনে মনে।এত রাতে ফোন ..কথা বলল না , কে তবে…..
সকালে চোখ খুলতেই অবাক হল তিতলি।অজানা অচেনা ধানখেত।জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে ট্রেন।ম্যাম বললেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢুকে যাবে এন জি পি। সকলেই যেন জলখাবার খেয়ে তৈরি হয়ে নেয়।
মৌ সকাল থেকে ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও কোথাও যেন খটকা!বৈভবও যথা সময়ে বেরিয়ে গেছে অফিসে বারকতক নিজেকে ধমকালো মৌ,  কেন,এমনভাবে ভাবছে গতকালের ফোনের কথা!  একটা অস্বস্তি…
ট্রেন এন জি পি ঢুকতেই হৈ হৈ করে নেমে পড়ল ওরা। তারপর সোজা বাসে। শহর ছেড়ে পাহাড়ের পথে এগিয়ে চলেছে ওরা।গন্তব্য পেলিং। এই প্রথম তিতলির পাহাড় দেখা।খুব আনন্দ হচ্ছে বন্ধুদের সাথে। ম্যাম-স্যারেরাও কেমন বন্ধু হয়ে উঠেছেন কয়েক ঘন্টায়!এমন সময় বেজে উঠল ফোন অচেনা নম্বর থেকে! বেশ কয়েকবার হ্যালো বলার পরেও নীরব অন্যপ্রান্ত! এমন কয়েকবার হবার পরে ফোনটা বন্ধ করে দিল তিতলি।মনে মনে ভাবল, কে এমন ফোন করছে! একটা খারাপ লাগা ….

৭.

দুপুর হতেই একটা মোটেল এর সামনে দাঁড়াল বাস। সবাই একে একে নেমে হাত মুখ ধুয়ে লাঞ্চ সারল। তিতলির অন্য বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল সেল্ফি ও গ্রুফি তুলতে।তিতলি দেখল ওর ফোনে ফুল টাওয়ার শো করছে। তখনই ফোন ঘোরালো  বাড়িতে।বেশ কিছুক্ষণ রিং হবার পরেই কেটে গেল ফোন।
বৈভব আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত।জাপান থেকে ডেলিগেট আসবে, তারপর প্রজেক্ট সাবমিশন।
আজকের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলে ওর প্রমোশন আটকায় কার সাধ্য! আজ আর কোনোকিছু ভাববে না। নিমগ্ন হয়ে কম্পিউটারে দেখতে লাগল খুঁটিনাটি। এমন সময় দরজায় নক করল কেউ। সাথে সুরেলা কন্ঠে,আসতে পারি? মুখ তুলতেই দরজায় আটকে গেল চোখ!
কিছু না ভেবেই আজ দুপুরে বেরিয়ে পড়েছে মৌ। মাঝে ফোন করে নিল আদরীকে।সেই স্কুল জীবন থেকে একে অন্যর বন্ধু। আদরী এমন একজন মানুষ যাকে সবকিছু বলা যায়।এত বছরেও সম্পর্কের টান একইরকম। প্ল্যান করল গড়িয়াহাটে দেখা করবে।  এসব ভাবতে ভাবতেই চেপে বসল বাসে।বেশ খানিকটা যাবার পরে ওর চোখ আটকে গেল জানলার পাশে বসা অনিদার দিকে! চোখাচোখি হতেই হাসিহাসি মুখ করে অনিকেত জানতে চাইল, কেমন আছে মৌ? পাশ কাটাতে না পেরে মৌও দেঁতো হাসি হেসে বলল, সব ভালো। মনে মনে ভাবল, এতটুকু লজ্জা নেই অনিদার।কত সহজে কথা বলছে!তবে কি ভুলে গেল ছোটবেলার স্মৃতি! নাকি ভান করছে! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কন্ডাক্টর গড়িয়াহাট বলে চ্যাঁচাতে লাগল।ধীরপায়ে গেটের কাছে এগিয়ে গেল মৌ।
বাড়িতে ফোন না পাওয়ায় একটু মন খারাপ হল তিতলির, এমন সময় হাত ধরে ওকে টেনে নিল মৈত্রী, ঋভু , সুহৃদ, সায়ন আজ দারুণ মাঞ্জা দিয়েছে , ম্যাম-স্যারদের লুকিয়ে সিগারেটের টান দিল।ওদের দিকেও এগিয়ে দিল প্যাকেট। তিতলি ছদ্মরাগ দেখালেও মৈত্রী নিল একটা। তারপর টান দিতেই শুরু হল জন্মের কাশি।সে চোখ মুখ লাল হয়ে একসা! ওসব দেখে হেসে খুন ঋভু।কোণাকুনি চোখ পড়তেই দেখে,আজান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা করে কাছে ডাকলেও সে না করছে। সবাই একটু অবাকই হল!তিতলি জানতে চাইল, কি হয়েছে? ইশারায় হাত নেড়ে ওদের আজান বলল তেমন কিছু না। তিতলির কেমন যেন আশ্চর্য লাগল আজানের ব্যবহার!দূর থেকে মনে হল, ওর চোখে জল, এগিয়ে গেল তিতলি……

৮.

আজান এর চোখে জল দেখে খুব কষ্ট হল তিতলির। আজান ওকে দেখে লুকোতে গেল বিষাদ। তিতলির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে মৃদু হেসে বলল, চাপ নিস না।ছোট থেকে শুনে আসছি দাদু দিদার কাছে, এমনই কোনো একটা খাদে বাবা-মা জাস্ট নেই হয়ে গেছিল আমাকে অনাথ ছাপ দিয়ে! তাই মাপতে যাচ্ছিলাম খাদ ও ক্ষত কতটা গভীর!এই এক হয়েছে দেখ, এত বড়ো হলাম তবুও জল আর আমাকে ছাড়ে না!  পিঠে হাত রাখল তিতলি। আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস হল আজান।
দরজায় তাকাতেই বৈভব দেখল একজন সুন্দরী মহিলা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।  কেমন যেন চেনা চেনা লাগল বৈভবের।তবুও গাম্ভীর্য নিয়েই বলল,আসুন।চোখে ঝুলিয়ে রাখল, প্রশ্নসূচক দৃষ্টি। এটা বুঝতে পেরে মহিলা বলল, ওর নাম নীলা।  নামটাও কেমন যেন চেনা ঠেকল! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না, কোথায় দেখেছে একে! এমনকি পার্ফিউমের অ্যারোমাও অনেক চেনা! কিন্তু কিভাবে…..
আদরীকে দেখেই এগিয়ে গেল মৌ , তারপর শুরু করল জাঙ্ক জুয়েলারির উইন্ডো শপিং।আদরীর পরণে সেই সাদা শাড়ি দেখে একটু বকল মৌ।  কিছুতেই কেন যে বোঝাতে পারে না সকলের ভালো থাকার অধিকার আছে, একজন চলে গেছে মানেই শেষ হয়ে যায়না আরেকটা জীবন!আদিত্যর অকাল মৃত্যুর পরে কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে মেয়েটা! নিয়ম করে একাদশী উপবাস করে।মেঝেতে ঘুমোয়।কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা মৌ। একটা মেয়ে কিভাবে নিজেকে ধীরে ধীরে শেষ করছে!অনেক বুঝিয়ে ও লাভ হয়নি। এমনকি এটাও বলেছে, যদি আদরী চলে যেত, তবে কি ঠিক এমনটাই করত আদিত্য?কেবল মৃদু হেসে এড়িয়ে গেছে আদরী।
পাহাড়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে বাস।চারিদিকে চা বাগান।পাশের খাদে বয়ে যাচ্ছে নদী। অপরূপ শোভায় সবাই মোহিত হয়ে গেল। বেশ খানিকটা চলার পরে বাস দাঁড়াল টেমিটি টি গার্ডেনে। সবাই আনন্দে লাফাতে লাগল। তিতলি ও বন্ধুরা ফটো তুলতে ব্যস্ত এবং স্যার ম্যাম সবাই গ্রিন টি চেখে দেখতে ও কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।তিতলিও কিনল বাড়ির জন্য। আজানের জন্য মনটা কেমন উদাস লাগছে! অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে আজান।হাসছে, গল্প করছে। তিতলির মন ছেয়ে যাচ্ছে অন্যরকম ভালো লাগার আবেশে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার সবাই চড়ে উঠল বাসে। গাইড বলল, গন্তব্য রা-বাংলা বুদ্ধ পার্ক।অচেনাকে জানা ও চেনার আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে চলল বাস ও একঝাঁক কচি নিষ্পাপ স্বপ্নালু চোখগুলো……

৯.

টিমেটি গার্ডেন থেকে এগিয়ে চলল বাস, রডোডেড্রন, ফার্ণ, নাম না জানা ফুলকে সঙ্গী করে স্বপ্নের জাল বুনতে লাগল তিতলি।নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল, কেন এত ভাবছে আজানের কথা!  বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হতেই লজ্জায় চোখ নামাল তিতলি। বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে ধরা পড়ে গেল মৈত্রীর চোখে। আরক্ত মুখে তাকিয়ে রইল জানলায়।
নীলাকে দেখে কেমন যেন ঘোর লাগল বৈভবের!
যতই ভাবছে,এড়িয়ে যাবে। ততবারই চোখ যাচ্ছে নীলার ক্লিভেজে। লাল শাড়িতে অসাধারণ লাগছে নীলা! বেশ খানিকটা সময় পরে বৈভব জানতে চাইল, উনি কেন এসেছেন?এমন আচমকা প্রশ্ন, শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ল নীলা। সেই হাসি জুড়ে ছিল রহস্য, বৈভবকে অবাক করে ওর নাক টিপে বলল … বাচ্চা ছেলে …বাকরুদ্ধ হল বৈভব!
সারাদিন দারুণ আনন্দ করে মৌ ও আদরী বসল একটা ক্যাফেতে। দুটো কাপুচিনো ও স্যান্ডউইচ অর্ডার করে গুছোতে লাগল প্যাকেটগুলো। এমন সময় চোখ গেল কোণায় বসা ছেলেটার দিকে।  ওকে দেখেই বেশ লাগল মৌ-এর।নস্টালজিক হয়ে পড়ল। মনে পড়ল, প্রথমদিনে দেখা বৈভবকে।কফি খেতে খেতে আড় চোখে দেখতে লাগল মৌ। বেশ খানিকটা পরে,ওদের অবাক করে ছেলেটা এসে বলল,
হাই আমি কবীর।যদি কিছু মনে না করেন এই টেবিলে বসতে পারি? সম্মতির অপেক্ষা না করে নিজেই বসে পড়ল চেয়ার টেনে। নিজের কার্ড এগিয়ে দিল আদরীর দিকে।
অবশেষে বাস এসে পৌঁছল রা- বাংলা বুদ্ধ মন্দিরে।  পাহাড়ের খাঁজে বিশাল বড়ো বুদ্ধ মূর্তি ও পার্ক। অসাধারণ একটা জায়গা। এরই মধ্যে তিতলি ও বন্ধুরা আবিষ্কার করল পার্কের একটা জায়গায় শুটিং হচ্ছে নেপালি সিনেমার গানের দৃশ্য, হৈ হৈ করে ওরা ছুটে গেল ওদিকে।

১০.

অপ্রস্তুত মুহূর্তে বেজে উঠল ফোন! বৈভব ফোন রিসিভ করতেই ওপ্রান্ত থেকে মিঃ ঝা বলল নীলা বলে একটি মেয়ে কি এসেছে?  যদি আসে, তবে যেন পাঠিয়ে দেন তাজ এর 660 নম্বর ঘরে।
মিটিং এর পরে সবাই মিলে ওখানেই যাওয়া হবে। তারপর রাতভর পার্টি! গলা খাকিয়ে নীচু স্বরে মিঃ ঝা বলল, বোঝেনই তো বৈভব বাবু! আজকাল শুধু মুখে ওই কি যেন বলে আপনাদের বাংলায়?. ..হা হা চিঁড়ে ভেজে না! মি ওশিকাকু তো একটা ঘাঘু মাল! বাঙালি মেয়ে খুব পছন্দ!নীলাও এসবে এক্সপার্ট।
সবই গেম। বুঝলেন কিনা! এক হাত দো এক হাত লো , হা হা হা…উচ্চস্বরে হেসে রিসিভার নামিয়ে রাখল মিঃ ঝা।স্বরে গাম্ভীর্য এনে নীলার দিকে তাকিয়ে বৈভব বলল, গাড়ি রেডি আছে , আপনি বেরিয়ে পড়ুন। রিসেপশনে গিয়ে আমার নাম করলেই, আপনাকে চাবি দিয়ে দেবে রুমের।
বৈভবকে অবাক করে দিয়ে নীলা বলে উঠল,তুমি সেই একই রকম রয়ে গেলে দেখছি!এমন কথায় প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো বৈভব।বলল, একথা বলার মানে? আপনি কি চেনেন আমাকে?
নীলা বলল, তোমার ওই বন্ধু, কি যেন নাম ছিল! …ও হ্যাঁ মনে পড়েছে পুষ্কর”উফফ একটা শয়তানের বাচ্চা!সে রাতে যা জ্বালিয়ে ছিল!আরে  তোমার মনে নেই! আগের বছর তুমি আর তোমার ওই হারামি বন্ধুটা পাব থেকে বেরিয়ে আমাকে গাড়িতে তুলে নিলে, তারপর সোজা ম্যাহক এ পাঞ্জাব এর হোটেল রুমে! তুমিও বাপু বেশ মাতাল ছিলে সেদিন!ভাবলাম দুজনেই বোধহয় একসঙ্গে….হা হা হা!সত্যি তুমি একটা বাচ্চা না হলে  অমন সিচুয়েশনে কেউ মুখ ঘুরিয়ে ঘুমোতে পারে?
তোমার বউকে তুমি খুব ভালোবাসো,তাই না?
তা সেই হারামীটা আছে কেমন?
একথা শুনে সব মনে পড়ে গেল বৈভবের।বলল পুষ্কর নেই আজ ছমাস হল।একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্টে সব শেষ।একদম কুকুরের মতো!
সুযোগই দিল না চিকিৎসার, স্পটেই ……
ছেলেটার বাড়ানো কার্ডটা বেশ যত্নকরে নিল আদরী , বেশ কোয়ালিফায়েড! চৌখশ কথাবার্তা!
বেশ খানিকটা পরে ওদের অবাক করে কবীর বলল  সে কলবয়।নম্বরটা রেখে দিন। এই বলে উঠে চলে গেল।
একথা শুনেই প্রচন্ড রেগে গেল মৌ ,ঘাড় ধরে  নিয়ে যেতে হয় পুলিশের কাছে, বলেই ছুড়ে ফেলে দিল কার্ডটা।কিন্তু ওকে অবাক করে কার্ডটা তুলে ব্যাগে ভরে নিল আদরী।
সবাই দারুণ আনন্দ করল বুদ্ধ পার্কে , মন্দিরের ভেতর সার বাঁধা চোর্তেন দেখে তিতলির খুব ইচ্ছে করল আজানের জন্য প্রার্থনা করতে।দারুণ শান্ত একটা পরিবেশ, সকল ধর্মগুরুদের জীবনী ও ছবি দেখে একটা অন্য জগতে বিরাজ করতে লাগল তিতলি।
বেশকিছুটা পরে আবার সবাই বাসে উঠল পেলিং এর উদ্দেশে।খানিকটা যাবার পর সবার পেটে ছুচোয় ডন মারার পরিস্থিতি।ম্যাম কেটারিং কে নির্দেশ দিল বাসেই খাবার সার্ভ করতে। কিন্তু ঘটল এক অঘটন। ম্যানেজার দেখে খাবারের ব্যাগ ফেলে রেখে এসেছে রা বাংলাতেই।একথা শুনে সবাই এর-ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।তবে কি আজ খাওয়া জুটবে না!খুব খিদে পেয়েছে যে!অজান্তে চোখে জল এল সবার। বুঝল, মা কেমন সাধাসাধি করে খাবার জন্য, আর আজ….! বাস্তব পরিস্থিতি হয়তো বা অনেকটাই বড়ো করে দিল ওদের একদিনে…..

১১.

নিষ্পাপ ক্ষুধার্ত মুখগুলো দেখে ম্যানেজার কে ম্যাম ও স্যাররা নির্দেশ দিলেন, হোটেল দেখে বাস দাঁড় করাতে।রা বাংলা থেকে পেলিং প্রায় চার সাড়ে চার ঘন্টার জার্নি।  অতটা সময় না খেয়ে..এমনিতেই অভ্যাস নেই সমতলের লোকের পাহাড়ি আঁকবাক রাস্তায় সফর!এই নির্দেশ পেয়ে ম্যানেজার চলে গেল ড্রাইভারের কাছে এবং ওদের ভাষায় বুঝিয়ে দিল নির্দেশ।
আজকের প্রজেন্টেশন দুর্দান্ত হল বৈভবের, সকলেই খুব খুশি মিঃ ওশিকাকু এক কথায় অর্ডার দিলেন এবং সাথে কোম্পানির নামে মোটা অ্যামাউন্টের চেক, এমনকি, বৈভবকে অফারও করে বসলেন যদি সে জাপান গিয়ে ওনার কোম্পানি জয়েন করে। মিঃ ঝা চেকটা পেয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন এবং সবার সামনেই অ্যানাউন্স করলেন বৈভবের প্রমোশন এর কথা। মনে মনে বেশ খুশিই হল বৈভব।এর মাঝে আড়ালে গিয়ে খুশির খবরটা জানিয়ে দিল মৌ কে।  সময়টা আজকাল ভালোই চলছে বৈভবের।তারপর দল বেঁধে চলল হোটেল তাজ বেঙ্গলে।
আদরীর কথা ফিরতে ফিরতে অনেক ভাবল মৌ।  কিছুতেই মেলাতে পারছে না! কেন,কি ভেবে, কবীরের কার্ডটা যত্ন করে রাখল আদরী!
তবে কি একাকীত্ব ওকে কুরেকুরে খাচ্ছে! এতটাই চাপা স্বভাবের মেয়ে ওর মুখ থেকে কিছুই বের করা যায়না।এতটা কাছাকাছি সত্ত্বেও কোথাও যেন একটা অদৃশ্য রেখা এঁকে রেখেছে আদরী।
খানিকটা পরেই বাস দাঁড়াল হোটেল ক্লাউড এন্ড রেন এর সামনে। আচমকা বাসটা দাঁড়াতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। ম্যানেজার গিয়ে ওনাকে সমস্ত ঘটনা বলার পরে উনি সাদর আমন্ত্রণ জানালেন সবাইকে। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, উনি মিঃ ব্যানার্জি। একেবারে খাঁটিবাঙালি। একসময়ে চাকরি করতেন ব্যঙ্কে কিন্তু সেই দশটা পাঁচটার জীবন বাঁচতে বাঁচতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন, পনেরো বছর চাকরি করার পরে একদিন ঠিক করলেন আর নয়।এবার বাঁচবেন নিজের মতো , আপন শর্তে।তীব্র আপত্তি উঠেছিল পরিবার থেকে।স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে ছিল ওনার পরিবার।এক সময় থাকতেন যাদবপুর সাইডে। বেশ চলছিল সবকিছু কিন্তু নতুন কিছু করে দেখানোর নেশায় নিয়ে ফেললেন এমন দুঃসাহসী পদক্ষেপ। এমন একটা পাহাড়ের বুকে ছোট কটেজ কাম হোটেল লিজ নিয়ে পড়ে আছেন এখানে।পরিবারের অভিমান এতটাই এই পাঁচ বছরে একটিবারও ওনার খোঁজ নেন নি ওরা। তবুও বেশ আছেন খোলা আকাশ, পাখির কুহুতান, শান্ত পাহাড়ের রূপ এবং একজন রাঁধুনি কাম হাউজকিপার নিয়ে।মাঝে মাঝে যখন এমন অতিথি আসেন বেশ ভালো লাগে ওনার।
এইসব কথার মধ্যেই এসে গেল এক প্লেট করে ধোঁয়া ওঠা ভাত,শাক ভাজা ও চিকেন কারি।তিতলি ও বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং গোগ্রাসে গিলতে লাগল, এমন দৃশ্য দেখে বড়ই তৃপ্তির হাসি হাসলেন মিঃ ব্যানার্জি।
হোটেলের বিল মিটিয়ে চলতে লাগল বাস
ভরপেট খাবার খেয়ে ও এত ছোটাছুটি করে সবাই একটু ক্লান্তই হয়ে পড়ল, একে একে বন্ধ হল চোখগুলো ভাতঘুমে।এমন সময় একটা জোর ঝাঁকুনি খেল সবাই।চোখ খুলতেই দেখল খাদের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে বাস।সকলে চিৎকার করতে লাগল আতঙ্কে…

১২.

অনেকক্ষণ নিজের সাথে লড়াই করতে করতে বোধহয় হেরে গেল আদরী , একটা ঘোরের মধ্যে ডায়াল করল নম্বরটা , অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এলো হ্যালো কবীর বলছি , কে ….
মধ্যরাত পর্যন্ত চলতে লাগল পার্টি , লাস্যময়ী নীলা! কেমন যেন ঘোর লাগাল বৈভবের চোখে।নিজেকে আর সংযত করলে পারল না সে আজ।ভেসে গেল ধোঁয়াবন্দি মায়াজালে।
মৌ ভাবল একবার ফোন করে কৈফিয়ত চাইবে আদরীর কাছে। সে কেন অমন ব্যবহার করল?কেন এত মুগ্ধতা ছিল কবীরের প্রতি? তবে কি,একাকীত্ব ঘুচিয়ে দিচ্ছে ওর অতীতের স্মৃতি!না কি শারীরিক ও প্রাকৃতিক চাহিদা ওকে করে তুলছে অপ্রকৃতস্থ!
বাস এগিয়ে চলছে খাদের দিকে , অসহায় চিৎকারে বিদীর্ণ হচ্ছে আকাশ, এমন সময় কচি মুখগুলো দেখল দ্রুত গতিতে চলন্ত বাস থেকে ঝাঁপ দিল ড্রাইভার, তারপর……..
সম্ভিত ফিরতে নিজেকে গুছিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল বৈভব।ড্রাইভার কে একটু তিরিক্ষি মেজাজেই ধমকে উঠল অকারণ।আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে,সোজা বাথরুমে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কি করে ফেস করবে মৌকে!এমন করে ছুটে বাথরুমে ঢুকল, কোনো অস্বাভাবিকতা কি ধরা পড়ল মৌ এর চোখে! এসব ভাবতে ভাবতেই বেজে ওঠা ফোনটা রিসিভ করল বৈভব।ওপ্রান্তের কথা শোনার সাথে সাথেই হাত থেকে পড়ে গেল ফোনটা।  একটা অস্বাভাবিক চিৎকার করে ডেকে উঠল বৈভব।মৌউউউউউউ…কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে লুটিয়ে পড়ল বৈভব।আর্তনাদ শুনে ছুটে এসে দরজা ধাক্কা দিতে লাগল মৌ।কি হল বৈভব ….দরজা খোলো… কি হয়েছে…… কার ফোন এসেছে …..উত্তর নেই। শুধু দরজার বাইরে দুম দুম আওয়াজ ও উচ্চস্বরে কান্নার আওয়াজে ছুটে এলো প্রতিবেশীরা, তারপর  ………………..
(সমাপ্ত)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।