তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের জিপে এক চিত্র পরিচালক ও বন্ধুদের সঙ্গে পুরুলিয়ার ঝালদায় নতুন ছবির লোকেশন দেখতে এসেছিলাম।সারাটা দিন ধকল গেছে।তবু ওদের অদম্য উৎসাহে তখনও ভাটা পড়েনি।সবাই সাপ্তাহিক হাটের বিকিকিনি দেখতে হাটে ঢুকে পড়েছে।আমি জিপ থেকে নেমে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
তখনই একটা মেয়ের দিকে আমার চোখ আটকে গেলো।বছর তেত্রিশ চৌত্রিশ বয়স।দেহে সুঠাম ছন্দ। ওর ঘামতেল মাখানো চকচকে মুখ থেকে চোখ সরছিল না।মেয়েটি একটা বড় থলে হাতে সেখানে উপস্থিত আছে বটে কিন্তু চোখ,দুটি চোখই অন্য কোনোখানে। বারবার সামনের কোঠা বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে।আমি ওকে দেখেই যাচ্ছি।হঠাৎ ওর সম্বিৎ ফেরে।ও আমার দিকে তাকায়।ওর কালো কষ্টিপাথরের মত মুখে নাকছাবিটা ঝিকমিক করে উঠলো।আমি ওর অনন্য মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।হাসি ওর মুখেও সঞ্চারিত হল।
তোমার নাম কি গো?হাটে এসেছ? কেনাকাটা করতে?
আমার নাম ফাতিমা।নিজের বানানো ছিট কাপড়ের সায়া জাকিট বেচতে এসেছিলাম।
সব বিক্রি হয়ে গেল?
মেয়েটি উত্তর দিলো না। আবার দৃষ্টি উধাও।কোনো এক গোলকধাঁধায় গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে খেই।বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে।
আমার একটু ফ্রেস হওয়ার দরকার ছিল। বলতেই ফাতিমা আমাকে ডেকে নিয়ে সামনের কোঠা বাড়িটার দিকে পা বাড়ালো।টিনের আগলটা সরাতেই ছুটে এলো একটা চিৎকোবরা কুকুর, লেজ নাড়তে নাড়তে ফাতিমার পায়ে লুটোপুটি করতে লাগলো।ঝোলা থেকে একটা পাউরুটি বের করে ফাতিমা কুকুরটাকে আদর করে খাইয়ে দিতে লাগলো।
বাড়িতে লোকজন কাউকে দেখা গেল না।বাঁ দিকে একটা ছোট ধানের মরাই।খড়ের গাদার কাছে কয়েকটা মুরগি, ছানাপোনা সহ চরে বেড়াচ্ছে।অদূরে পাতকুয়ো।ফাতিমা অনায়াসে কুয়ায় বালতি নামিয়ে ঠাণ্ডা জল তুলে দিল।মুখ হাত পা ঠাণ্ডা জলে ধুতে পেরে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
আমি আর ফাতিমা বেরিয়ে আসছিলাম কিন্তু কুকুরটা কিছুতেই ফাতিমাকে ছাড়বে না।অস্থির লাফ ঝাঁপ।তড়পাচ্ছে। কুঁই কুঁই করে কাঁদছে। ফাতিমা টিনের আগলটা আবার টেনে দিয়ে কুকুরটাকে আটকে দিলো।
আমার চোখে অনেক প্রশ্ন…।প্রতিমা আন মনে কথা বলে যাচ্ছিল….।
কাল্লুটা তো আমারই পোষা কুকুর,এই বাড়িটা তো বছর দুই আগে আমারই ছিল।আমার আমার।
ছিল মানে?
ওরে বাবা আমাকে এখনই তুলিন যাওয়ার বাস ধরতে হবে গো দিদিমণি। তুলিনে ভাইজানের কাছেই থাকি তো! প্রতি হাটবারের দিনেই আসি তো!সায়া বেলাউজ বানিয়ে এই হাটেই বিক্রি করি।
দেখো কাল্লুটা এখনো চিৎকার করছে।ছটপট করছে।কাঁদছে।তোমাকে বোধ হয় যেতে দিতে চাইছে না।
দ্রুত চলে যেতে যেতে ফাতিমা পিছন ফিরে বললো…মিয়া তো আমাকে তিন তালাক দিয়েছে।আমার কাল্লু তো সে সবের মানে বোঝে না….