• Uncategorized
  • 0

মুড়িমুড়কি -তে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

অনুবাদ সংস্কৃতি ২

কিন্তু তাই বলে অনুবাদ করা কি থেমে থাকে?
জীবনে কি আমরা প্রতিনিয়ত অনুবাদ করে চলি না? শুভ্রদার বাবা, থানার দারোগা ছিলেন, তিনি বলতেন, শুভ্র যখনই আমায় বাবা না বলে বাওয়া বলে ডাকে, আমি বুঝে যাই এ মাসে তার একটু বেশি টাকার দরকার হবে।
তাছাড়া পরীক্ষায় খারাপ করলে, বা ইশকুলে গার্জেন কল হলে বাবারা বাড়িতেই ঢোকেন, ওগো শুনছো, তোমার ছেলের কান্ড….ইত্যাদি বলতে বলতে। অথচ সেই ছেলেকেই যখন পাড়ার লোকে এসে বলে যায় বিল্টুর মত ছেলে হয় না, তখন কিন্ত সেই বাবারাই সচরাচর, ছেলে কার দেখতে হবে তো, বলে জামা ছোট করে ফেলে।
অনেক বাঙালি গৃহস্থ বাড়ির মতই আমার মামাবাড়িতে আবার আরেক ধরনের অনুবাদ সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। মামা মাসির প্রায় সবাই সাহিত্য বা ইতিহাসের ছাত্র হওয়ার দরুন ইংরাজি রোমান্টিক কবিদের খুব ভক্ত ছিলেন। এঁরা ঝগড়া করার সময় শেলী বায়রন নিয়ে ঝগড়া করে, ড্যাফোডিল নিয়ে কার কবিতা বেশি ভাল সেই চুলচেরা তর্ক করে, কোলরিজের অহিফেন-নির্ভরতার গল্প করে কানের পোকা বের করে দেওয়ায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
একাধিক কবিতা গড়গড় করে মুখস্থ বলে যাওয়া এঁদের আরেকটি ভীতিপ্রদ বৈশিষ্ট্য ছিল, কারণ কবিতাটির চার ছয় লাইনের আবৃত্তির পরই কুইজের স্টাইলে প্রশ্ন উদয় হবে , কার কবিতা?
তাছাড়া এক জ্ঞাতি মামা ছিলেন, যিনি ১৪ ১৫ বছর বয়স থেকেই অনায়াস অনুবাদ করতেন তাঁর প্রিয় ইংরাজি কবিতার। ওয়ার্ডসওয়ার্থের লুসি গ্রে’র অনবদ্য তর্জমা ও বাড়িতে মুখেমুখে ফিরতো
“লুসি গ্রের কথা শুনিতেন প্রায়
দেখিতেন তারে কবি
জলাভূমি যবে হইতেন পার
প্রভাতে উদিলে রবি।
ছিল না তাহার ক্রীড়াসাথী কোনো
ছিল না কো সহচরী
লোকালয়ে কবি দেখে নাই কভু
তার মত সুন্দরী।”… ইত্যাদি।
এঁদের পাল্লায় পড়ে আমাদের একটা ধারণা হয়েছিল, যেকোনো কবিতা পড়ে , কে বলেছেন, কেন বলেছেন ইত্যাদি কচকচিতে না গিয়ে, কবিতাটাকে নিজের ভাষায় লিখে ফেলতে পারলে হয়ত তার জানটাকে ধরা সহজ হবে। কাজেই আমিও একবার একটা কবিতার অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম সেই জমানায়। লর্ড টেনিসনের ক্রসিং দ্য বার  বা বাঁধ পেরোনো।

“সূর্য যখন অস্ত যাবে, জাগবে সন্ধ্যাতারা
আমার জন্য আসবে যেদিন ডাক সে বাঁধনহারা।
তখন পথ যেন হয় শান্ত
না গরজায় যেন সাগর অসীম অতলান্ত।

গহীন ঘুমের ভরা কোটাল
স্তব্ধ কানায় কানায়
দিনের সফেন উচ্ছ্বাস যার সঙ্গে নাহি মানায়
তেমন গভীর গহন হতে
এসেছিলাম কালের স্রোতে
সাঁঝের বেলা ফিরিয়া যাই
পথিক, পথশ্রান্ত।
শঙ্খ বেজে উঠলে গোধূলিতে
আঁধার নেমে আসবে  ধরাতলে
অশ্রুবারি বিয়োগব্যাথায় ভরা
ফেলো না কেউ বিদায় দেওয়ার ছলে
পেরিয়ে দেশ কালের বাধাটুকু
যাবেই দূরে আমার কাঠের তরী
আমার মানব জন্মতরীর মাঝি,
মুখখানি তাঁর দেখবো, আশা করি।”
যাই হোক, সেই জ্ঞাতিমামা কিন্তু অনতিপরেই একদিন লুসি গ্রের মত হারিয়ে গেলেন। না, কোনো ঝঞ্ঝা নিশীথে লন্ঠন হাতে জলাভূমি পার হতে গিয়ে নয়, বরং নিজেরই মধ্যে এক নৈঃশব্দের সঙ্ঘারাম রচনা করে ডুবে গেলেন। আমার জন্মের আগে। তিনি আমার স্মৃতিতে বুদ্ধের মত চুপ করে বসে থাকা এক ধ্যানী স্থবির, যার বাইরের জগতের সাথে আর কোনো ধ্বনির আদান-প্রদানের প্রয়োজন  নেই। কে জানে বাকি জীবন কোন শব্দমালার নৈঃশব্দ্যে অনুবাদ করে গেলেন তিনি।
কারোরই আজ সেই প্রথম দুটি স্তবকের তর্জমার বেশি কিছু মনে নেই। তা বলে কি সেটা শেষ করা হবে না কখনো? দেখাই যাক না চেষ্টা করে!
“লুসি গ্রের কথা শুনিতেন প্রায়
দেখিতেন তারে কবি
জলাভূমি যবে হইতেন পার
প্রভাতে উদিলে রবি।
ছিল না তাহার ক্রীড়াসাথী কোনো
ছিল না কো সহচরী
লোকালয়ে কবি দেখে নাই কভু
তার মত সুন্দরী।
দেখিবে হরিণ শাবক খেলিছে,
শশক ছুটিছে ঘাসে
মিষ্টি বালিকা লুসি গ্রে’র দেখা
পাবে না আর আশেপাশে।
-“লুসি মা একটু এগিয়ে দেখবি
লন্ঠন নিয়ে হাতে?
শহরের থেকে ফিরছে মা তোর
আজ ঝঞ্ঝার রাতে।
-“নিশ্চয়ই যাবো বাবা” বলে লুসি
“আছে তো এখনো বেলা।
মোটে দুই-ঘড়ি সময় এখন
আকাশে চন্দ্রকলা।”
বোঁচকা-বুঁচকি বেঁধে নিয়ে সাথে
বাবা কাজে গেলে তার
লন্ঠনখানি হাতে নিয়ে লুসি
হল যে ঘরের বা’র।
ক্রীড়াচঞ্চল পাহাড়ি হরিণ
সে যেন, খেয়ালে ছোটে।
তার পায়ে লেগে ঝুরো বরফের
ঘূর্ণির ধোঁওয়া ওঠে।
ঝড় ধেয়ে এল সময়ের আগে,
লুসি পথ চলে একা
কত যে চড়াই-উতরাই, তবু
শহর দিল না দেখা।
মা-বাপের প্রাণ বেদনাদীর্ণ
চিৎকার করে ডাকে
এতটুকু কোথা নাহিক’ চিহ্ন
খোঁজ দিতে, ঘোর রাতে।
প্রভাতে একটি টিলায় উঠিয়া
জলাভূমি পানে ঘুরে,
দেখিল কাঠের সেতুটি, গৃহের
ফার্লঙ-টাক দূরে।
“তবে কি আমরা স্বর্গে মিলিব?”
হাহাকার করে, মাতা
বরফের মাঝে পাইল খুঁজিয়া
পদছাপ তার পাতা
সেই পদছাপ নেমে গেছে সোজা
খাড়া পাহাড়ের শেষে
হথর্ণের ঝোপ পেরিয়ে, থামেনি
পাথুরে দেওয়ালে এসে,
তারো পরে ছিল খোলা মাঠখানি
পদছাপে তার ভরা
দুইজনে অনুসরণ করিয়া
সেতু পৌঁছিল ত্বরা ।
বরফে আকীর্ণ তট হইতে
সেতুর মধ্যাবধি\
লুসির পায়ের চিহ্ন পড়িয়া,
নিচে প্রমত্তা নদী।
আজো কেউ কেউ বলে বেঁচে আছে
লুসি, চির প্রাণবন্ত।
অরন্যানীর মাঝে ফেরে একা
দেখা দেয় এলে ক্ষণ তো।
পিছনে ফিরিয়া চাহে না সে কভু,
চলা যেন ভেসে যাওয়া।
একা বালিকার একখানি গান
শিস দিয়ে গায় হাওয়া।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।