• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ৬)

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

পূর্ব প্রকাশিতের পর… 

ফকির পাড়া পেরিয়ে ডানদিকে তাকালে একটা ন্যাড়া মতো টগর গাছ চোখে পড়ে। রাকা গাছের নীচে এসে সাইকেল স্ট্যাণ্ড করে দাঁড়ায়। টগর ফুল তেমন প্রিয় নয় রাকার তবু দুএকটা পড়ে থাকা ফুল কুড়িয়ে নিল। নিজের কানে গুঁজে নিয়ে একটা সেল্ফি তুলল। আর ফেসবুক স্টোরিতে এড করে দিল। কানে গোঁজা ফুল পকেটে নিয়ে চোঁ চোঁ করে সাইকেল চালিয়ে বড় রাস্তায় উঠল। আর একটু এগিয়ে বাঁদিকে অর্ণবদার গ্যারেজ।
-‘অর্ণবদা কাজটা আমার চাই।’ সাইকেল স্ট্যান্ড করতে করতে বলল রাকা। টুকটুকে ফর্সা, হ্যাণ্ডসাম ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে অর্ণব। অর্ণবের স্মৃতি ঝলসে ওঠে। মোমবাতি মিছিলে এই ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার। অনেকক্ষণ কথাও হয়েছিল। তখন কি জানত রাকা তার কাছে কাজ চাইতে আসবে।
-‘তুই কি পারবি রাকা!’ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন অর্ণব।
-‘আগে দিয়েই দেখো না! না পারলে ছাড়িয়ে দেবে।’
-‘ঠিক আছে কাল থেকে চলে আয়।’
অর্ণবদা গ্যারেজের হেড মিস্ত্রি আর হেল্পারদের ডাকল। পরিচয় করিয়ে দিল। -‘এই হল রাকা। আগামীকাল থেকে ও আমাদের গ্যারেজের হিসেব রক্ষক। ওর অনারে একবার চা আর ওমলেট হয়ে যাক।’
অর্ণবদার ব্যবহারে  মুগ্ধ রাকা। মানুষ তাহলে এমন ভগবানের মতোও হয়! কিন্তু ভগবানকে তো কোনোদিন দেখেনি রাকা। দেখা তো দূরের কথা, কথাই হয়নি। আরে দেখা হলে তো কথা হবে! কেন! কত লোকের সঙ্গেই রাকার কথা হয় কিন্তু দেখা হয় না। হবেও না হয়ত কোনোদিন। সেতো ফেসবুকে! ভগবান কি ফেসবুক করেন! ধ্যাত কী যে আবোল তাবোল ভাবনা আসে মাথায়!
এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই রাকা ওদের সঙ্গেই লম্বা বেঞ্চে বসে চা আর ওমলেট খেল। সকাল সকাল মুডটাও ভাল হয়ে গেল। গতকাল থেকেই ঝামেলা আর ঝামেলা! এই এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
অর্ণবদার গ্যারেজের সব হেল্পারই হেড  মিস্ত্রিকে  মামু বলে ডাকে। আর মাঝে মাঝে সদ্য দেখা ফিলমি ডায়লক ঝাড়ে,’মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে।’
রাকা জিজ্ঞেস করে, ‘মামু, এপাড়ার শ্মশান কোন দিকে?’
মামু হাসে। বলে, ‘ এই ছেলে শ্মশান দিয়ে কী হবে রে! বরং তোকে শ্মশান কালী মন্দিরে নিয়ে যাব চল।’
রাকা মোবাইলেই শ্যামা সংগীত শোনে। ‘আমি মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানি না…’ শুনতে শুনতে চোখে জল আসে। তারপর কোথায় যেন হারিয়ে যায়। গান শুনতে শুনতে বাবার কথা মনে পড়ে। তাকে কাঁধে চাপিয়ে ছাতা পরবের মেলাতে নিয়ে গেছে। কাঁধে চেপে থাকলে একটা বিরাট সুবিধা হয়, যার কাঁধে চেপে আছে তার থেকেও উঁচুতে চোখ থাকে বলে বাবার চেয়ে রাকায় বেশি বেশি দৃশ্যের স্বাক্ষী থাকে। একটা মোরগ কীভাবে আর একটা মোরগকে কাইত মেরে কাত করে দেয় ছবির মতো পরিস্কার দেখতে পায়। কাঁধে চেপে কাগজের ঘূরঘূর্ণি বেশি বাতাস পায় বলে জোরে জোরে ঘোরে তাতেও অন্য রকম মজা হয় রাকার।
তুলি মাথার মধ্যে এলেই কেবল ঘূর্ণিপাক। কথা সরে না মুখ থেকে। কে যেন মুখ চুপ ধরে। স্কুলে যাওয়ার পথে তুলির ছবি তুলে রেখেছিল রাকা। মোবাইলের ওয়ালপেপারে রেখেছে তুলির হাসি হাসি মুখ। স্ক্রিনে চুমু খেলেই বাতাসে আগুন লাগে। মাথার রক্ত নেমে আসে আঙুলে। রাকা ভাবে যদি সত্যি সত্যি চুমু খেলে কী রকম লাগবে! ভাবতে চেষ্টা করে। না,  কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কোনো কোনো দিন কাজ করতে করতেই আনমনা হয়ে যায় রাকা।
কেবল জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। চুমু খেতে ইচ্ছে করে। নাভির নিচে জেগে ওঠে অন্য পৃথিবীর গান। সে গানের সুর লয় তাল সব আলাদা। হাওয়া এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর কী যে হয় অনন্ত অন্ধকার নাকি অনন্ত আলোর দিকে যেতে থাকে। গিয়ে কোথায় পৌঁছায় রাকা জানে না। কেবলই বেশি বেশি ঘুম পায়। বিছানা থেকে উঠে রাকা পেচ্ছাব করে আসে।  অর্ণবদা ইয়ার্কি মারে। -‘কিরে প্রেমে পড়েছিস নাকি! হিসেব ভুলভাল করছিস। আমাকে যে ডোবাবি রে রাকা। তা মেয়েটি কে, জানতে পারি!’
রাকা লজ্জা পায়। লজ্জায় লাল হয়। মুচকি হাসে। এই নির্মল হাসিটুকুই অর্ণবকে মোহিত করে আর রাকাকে  নীল। চরাচর জুড়ে ফুটে ওঠে কাশফুল।
অর্ণবদা অদ্ভুত ফুর্তিবাজ মানুষ। হৈ হৈ করে দিন কাটিয়ে দেয়। অথচ ওর জীবনে অনন্ত দুঃখ, যন্ত্রণা সব কিছু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গোপনে। দুঃখ লুকিয়ে বেঁচে থাকা! আশ্চর্য লাগে। মাও তো অমনি। অর্ণবদার সঙ্গে মিল আছে। অর্ণবদা লাভের টাকা পাঁচজনে ভাগ করে নেয়। নিজে একটাকাও বেশি নেয় না। বরং মাসের প্রথম দিন ফ্রিতে মুরগির ঝোল আর ভাত অর্ণবদা নিজের ভাগের টাকায় খাওয়ায়।
একবার অনেক রাত হয়ে গেল। সেবার প্রথম মাল খেল রাকা। মাল নয়। বিয়ার। রাত হলেই মামু রামভক্ত হয়ে যায়। তারপর হনুমানের মতো জ্ঞান দেয়। -‘বুঝলি রাকা, ধোয়া তুলসিপাতা থাকলে এই লাইনে চলে না। যখন যেমন তখন তেমন। যেমন জল তেমন মাছ না হলে বাঁচবি না রাকা বুঝলি! পৃথিবী খুব কঠিন রেস্তোরা। মানিয়ে মানিয়ে খেতে হয়। দুঃখ ছেকে আনন্দে ডুবিয়ে দিতে হয় ইয়ে দো দিন কা জিন্দেগি!’
সেদিন রাকা শুয়েছিল অর্ণবের পাশে। হঠাৎ একি নাভির নিচে একটা শক্ত হাত ঘুরছে। সমুদ্র মন্থনের অনন্ত নাগ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে শরীর। কেউ যেন খুশবু মাখিয়ে সেঁকে দিচ্ছে আগাপাশতলা। এতো ভালো স্বপ্ন কখনও দেখেনি রাকা। স্বপ্নের মধ্যে উথালপাথাল অমৃত। অগ্নুৎপাতের মতো প্রথম আত্মপাতের আনন্দে উথলে উঠল রাকা। -‘অর্নবদা। জল খাবো।’
অর্ণবদাকে এইভাবে দেখে চমকে উঠল রাকা। কেঁদে ফেলল। মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে থাকল। অর্ণবদার উপর রাগ হল। ঘেন্নায় থুতু ছেটাতে ইচ্ছে হল। এক্ষুণি পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করল। অর্ণবদা নির্বিকার। গান গাইছে। “তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ/ ওগো ঘুম ভাঙানিয়া।” গান শেষে বলছে, ‘আরে বোকা কাঁদছিস কেন!”
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *