• Uncategorized
  • 0

গল্পে পাপিয়া মণ্ডল

দীপ জ্বেলে যাই

একদিন সন্ধেবেলায় হঠাৎ রুক্মিণীর নাম্বার থেকে একটা এস.এম.এস এলো সৃজার ফোনে।
“অলোকেশ তুমি কেমন আছো এখন? তোমার কি খুব মাথা ব্যথা করছে। আমার তোমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে গো। যদি তোমার কাছে থাকতে পারতাম, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারতাম, আমার খুব ভালো লাগতো।”
এস.এম. এস টা দেখেই হকচকিয়ে গেলো সৃজা। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই আবারো  রুক্মিণীর মেসেজ এলো—“ভুল করে তোর কাছে একটা মেসেজ চলে গেছে।”
মাথা কাজ করছিল না সৃজার। রুক্মিণী ওর খুব কাছের বন্ধু। বেশ কয়েক বছর ধরেই ওদের একমাত্র ছেলেদের মাধ্যমে ওদের আলাপ আর তারপর বন্ধুত্ব। একই শহরেই বাড়ি দুজনের। একে অপরের সুখ-দুঃখ, এমনকি যে কোনোরকম পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিষয়ও ওরা দুজন ভাগ করে নেয়। রুক্মিণীর স্বামী উজ্জ্বল আর সৃজার স্বামী উদ্দীপণ।একে অপরের স্বামীকে ওরা দাদা বলে। মাঝে মাঝেই দুই পরিবার মিলে ঘুরতেও যায়। এককথায় রুক্মিণীর সব কথা সৃজা জানে আর সৃজারও সব কথা রুক্মিণী জানে।
কিন্তু কে অলকেশ? ওর নাম তো রুক্মিণীর মুখে কোনদিনও শোনে নি সৃজা। মেসেজটা পড়ে তো অলকেশকে রুক্মিণীর খুব কাছের কেউ মনে হলো।তারপর সৃজা সরাসরি রুক্মিণীকে প্রশ্নটা করেই ফেললো। রুক্মিণীও উত্তরে জানলো যে অলকেশ ওর খুব ভালো বন্ধু। সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে রুক্মিণীর অনেক বন্ধু-বান্ধবকেই চিনতো সৃজা। তারা অনেকেই এখন সৃজারও বন্ধু। কিন্তু  অলকেশকে কোনোভাবেই চেনে না ও। রুক্মিণীও ওর ব্যাপারে খুব বেশি বলতে চাইছে না, বুঝতে পেরে সৃজাও চুপ করে গেলো। কিন্তু অলকেশ আর রুক্মিণীর মধ্যে কোথাও যেন একটা অন্যরকম সম্পর্কের গন্ধ পেলো। তবে সেটা ও কিছুতেই প্রকাশ করলো না রুক্মিণীর কাছে।
কেটে গেলো আরো কয়েকটা বছর। সৃজা আর রুক্মিণীর বন্ধুত্বও সেই আগের মতোই আছে। কিন্তু বিগত কয়েকমাস ধরে রুক্মিণী শারীরিক ভাবে খুব ভুগছে। একটার পর একটা অসুখ এসে বাসা বাঁধছে ওর শরীরে। দিন কে দিন ওর চেহারা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।  মেজাজও ঠিক থাকে না। আবার কারো সাথে তেমন করে কথাবার্তাও বলতে চায় না। ওর এমন অবস্থা দেখে মনে মনে খুবই কষ্ট পেতে থাকে সৃজা। রোজ ফোনে ওর খোঁজ নেয়, মাঝে মাঝে বাড়িও যায়। ওকে দেখেই ওর চোখে জল চলে আসে। উজ্জ্বলকে বলে—–“ওর চিকিৎসা ভালো করে করাও দাদা!”
খুবই ভালো মানুষ উজ্জ্বল। রুক্মিণীকে সুস্থ করার জন্য যে যেখানে বলছে, যা বলছে সেইভাবেই ওর চিকিৎসা করাচ্ছে।
রুক্মিণীর এমন অবস্থা দেখে একদিন সৃজার সেই এস.এম.এস টার কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো অলকেশের কথা। ও অনুমান করলো,  রুক্মিণীর অসুখটা যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। কিন্তু ওকে জিজ্ঞেস করলেও,  এই ব্যাপারে কিছুই বলবে না, এটাও জানে। তাই মনে মনে একটা বুদ্ধি বের করলো।
সেদিন রুক্মিণীকে নিয়ে পাশের শহরে ডাক্তার দেখাতে গেছে উজ্জ্বল। সৃজা ফোন করলো রুক্মিণীর ফোনে। প্রথমে ওর শরীরের খোঁজ নিল। ডাক্তার তখনো আসেন নি। এদিক থেকে সৃজা অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো। রুক্মিণী বললো—“কি হয়েছে, এমন করে কেন কাঁদছিস? আমি সুস্থ হয়ে যাব দেখিস।”
সৃজা কাঁদতে কাঁদতেই বললো—-“তোকে খুব মিস করছি রে। একটা কথা বলবো। ফিরে ফোন করিস।”
রুক্মিণী বললো—“বল না এখন। ডাক্তার তো আসেন নি।”
সৃজা তখন বললো—–“আমি মনে হয়, অরুণাভর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি রে।”
অরুণাভ রুক্মিণীর বন্ধু ছিল। সেই সূত্র ধরে বছর চারেক আগে সৃজার সাথেও বন্ধুত্ব হয় ফেসবুকে। তারপর থেকেই ওরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু।
ওর কথা শুনে রুক্মিণী বললো—-“এ মা! এ আবার কি? তুই এসব ভাবিস না। আমি জানি তুই দাদাকে কতোটা ভালোবাসিস।”
সৃজার স্বামী উদ্দীপণ  খুবই ভালোমানুষ আর সত্যিই সৃজা ওকে খুবই ভালোবাসে।
সৃজা বললো —-“তুই বাড়ি ফিরে ফোন করিস।”
সন্ধেবেলায় রুক্মিণী ফোন করলে, প্রথমে ওর শরীরের খবর নিলো সৃজা। তারপর অরুণাভর প্রতি ওর কিরকম অনুভূতি কাজ করছে সেটা জানালো।
ওর কাছে এইধরনের কথা শুনে, রুক্মিণী গরগর করে, অলকেশের সঙ্গে ওর সম্পর্কের পুরোটা বলে দিলো। দীর্ঘ পাঁচবছর ওদের মধ্যে ভালোবাসার একটা সম্পর্ক থাকার পর, কয়েকমাস যাবৎ অলকেশ ওকে অবহেলা করতে শুরু করেছে। ওর এই অবহেলা সহ্য করতে না পেরে, রুক্মিণী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
ওর কাছে সবটা শুনে, মনে মনে খুবই চিন্তিত হলো সৃজা। আসলে পুরো ঘটনাটা ও আঁচ করতে পেরেছিলো আগেই। কিন্তু রুক্মিণী কিছুতেই স্বীকার করবে না জেনেই, অরুণাভর প্রতি দূর্বলতার (মিথ্যে) কথাটা ওকে জানায়। ওর কাছে একই রকম ঘটনার আভাস পেয়ে রুক্মিণীও সবটা ওকে বলে।
এরপর প্রতিদিন এক একটা মুহূর্ত তৈরী করে সৃজা—“জানিস, আজ অরুণাভ আমার মেসেজের রিপ্লাই করে নি। আমায় কেমন যেন ইগনোর করছে।”
এইভাবে মুহূর্তের পর মুহূর্ত সাজাতো প্রতিদিন।মুহূর্ত আর অনুভূতিগুলো এক্কেবারে মিলে যায় রুক্মিণীর সাথে।  সৃজা ওকে একটু একটু করে বোঝাতো—“কি লাভ যে তোকে চায় না, তারজন্য এভাবে নিজের শরীর খারাপ করার? তোর স্বামী আছে, সন্তান আছে, আমরা আছি। আমাদের জন্য তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ।”
প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত প্রত্যেকটা কথা সৃজার সাথে ভাগ করে রুক্মিণী।  সৃজাও ওর মতোই কোনো ঘটনা সাজায় অরুণাভকে নিয়ে। তারপর আবারো বোঝায় ওকে।
এইভাবে ধীরে ধীরে রুক্মিণীর মধ্যে একটা পাপবোধ নিয়ে আসে সৃজা। ও নিজেই বারবার বলে—-“আমার এতো ভালো স্বামী, সন্তান, সংসার থাকতেও, কেন শুধুশুধু অরুণাভর প্রতি দূর্বলতা দেখাবো?”
ওর কথা শুনে, রুক্মিণীর মনেও এই ভাবনাটা দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়। ও তখন সৃজাকে বলে—-“একদম ঠিক। আমরা কেউই আর ওদেরকে নিয়ে ভাববো না।”
রুক্মিণী এখন অলকেশের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখে। ও মেসেজ করলেও টুকটাক রিপ্লাই দেয়। এখন অনেকটাই সুস্থ ও।  আগের মতোই আবার সংসারের হাল ধরেছে। তবে রোজ একবার ফোনে সৃজার সাথে কথা না বললেই ওর চলে না। ওর এমন পরিবর্তনে যারপরনাই খুশি সৃজাও।
কিন্তু,  রুক্মিণীকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে, অরুণাভর প্রতি মিথ্যে দূর্বলতার গল্প ফেঁদেছিলো সৃজা। এখন ওর মনে হয়, সেই সাজানো গল্পটা কোথাও যেন ওর মনে দৃঢ়ভাবে বাসা বেঁধে ফেলেছে। সত্যি সত্যিই নিজের অজান্তেই কখন যে গল্পটা ওকে জড়িয়ে ফেলেছে সেটা ও নিজেও টের পায় নি।  অরুণাভর সামনে এই সত্যিটা কোনোদিনও যেন উদ্ঘাটিত না হয়, সেইজন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যায়।নীরবে, নিভৃতে  সারাজীবনের জন্য এক অব্যক্ত যন্ত্রণা ওকে বয়ে বেড়াতে হবে….!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।